পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Neo রবীন্দ্র-রচনাবলী কর্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হলেন স্বৰ্গ থেকে আদেশ নিয়ে এসে ; এবং প্রকৃত দেশপ্রেমে অনুপ্রাণিত হয়ে এমন দক্ষতার সঙ্গে সব ব্যবস্থা করলেন যে অনেকেরই মনে হয়েছিল, তিনি অসম্ভবকে সম্ভব করে তুললেন । শিক্ষা ও মানসিক সংস্কারের ব্যবস্থা এতদিন অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল, এখন আবার সে-সব মহারাজের উৎসাহ পাচ্ছে। আধুনিক প্ৰণালীতে অনেক স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা তো হয়েছেই, তা ছাড়া নিয়মিতভাবে যোগ্যতম ছাত্রদের বিদেশে পাঠানো হচ্ছে টেকনিকাল শিক্ষালাভের জন্য । আমাদের কবি ও ঋষিদের স্মৃতি এতদিন তাদের ভক্তদের প্রাণের মধ্যেই বাসা বেঁধে ছিল ; এখন সেই স্মৃতিকে বহির্জগতে রূপ দেওয়ার চেষ্টা চলছে ; এটা শুভ লক্ষণ ; এর থেকে বোঝা যায়, আমাদের অতীত গৌরবের চেতনা জাতির প্রাণের মধ্যে উদবুদ্ধ হচ্ছে । সমস্ত পারস্যবাসী ও বিদেশী পারস্যবন্ধুদের মনে আশা হয়েছে যে, এই অদ্বিতীয় সম্রাটের সুদক্ষ নেতৃত্বে পারস্যদেশ আবার জগতের কল্যাণসাধনের শক্তি নিয়ে আবির্ভূত হবে । আশা করি, ডক্টর ঠাকুরকে এই-যে আমাদের প্রাণভরা অভিনন্দন জ্ঞাপন করলাম, এর জন্য তার স্পর্শভীরু স্বভাবে কিছু আঘাত লাগলেও তিনি আমাদেরকে ক্ষমা করবেন । যদিও জানি “অলংকারবিহীন সৌন্দর্যই সুন্দরতম অলংকার” তবুও তার প্রতি আমাদের যে ভক্তি তা একটু নিবেদন না করে পারলাম না । আমাদের ভরসা আছে, ডক্টর ঠাকুর তার এই ভ্ৰমণে আনন্দ পাবেন, এবং সত্যকারের শ্রেষ্ঠ জগদগুরুর প্রাপ্য যে শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতা পারস্যে তার কোথাও কোনো অভাবই হবে না । কবির উত্তর পারস্যের ভ্ৰাতৃগণ, আমার সম্বন্ধে আপনাদের অনুগ্রহবাণীর জন্য আমি আন্তরিক কৃতজ্ঞ । আপনাদের কাছে আসাটা আমার জীবনে একটা বড়ো সুযোগ, এ কথা নিশ্চয় করে বলতে পারি। এই প্ৰথম নিবিড়ভাবে পারস্যের স্পর্শ অনুভব করা গেল । আর যে-কদিন আপনাদের দেশে থাকব। তার মধ্যেই পারস্যবাসীদের সঙ্গে আরো গভীরতর পরিচয়-সাধনের আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি । আমি কবি— আমি সেই কবিসংঘের একজন ধাদের বাণী মনুষ্যত্বের অন্তরে পেঁৗছনোর পথ খুঁজে নেয় কোলাহলময় বক্ততার মধ্য দিয়ে নয়, অনন্তের আলয় যে গভীর স্তব্ধতা তারই মধ্য দিয়ে । প্রচার করা বা শিক্ষা দেওয়া আমার কাজ নয়- আমি আছি। প্ৰাণের আহবানে সাড়া দেবার কাজে, অনুভূতির ভাষায়, সৌন্দর্যের ভাষায় । কবি যশোর কোনো দাবি যদি আমার থাকে তবে তার উদভব হল সেই মৌন নিঃসীমতায় যেখান দিয়ে মানবহৃদয়ের মহাদেশে অনুপ্রেরণা ও ভাবম্পন্দনের প্রাণময় আদান-প্ৰদান চলতে থাকে । শৈশব থেকেই আমি মানুষ হয়েছি নির্জনতার আবহাওয়ায়, প্রকৃতির নিবিড় সংস্পর্শে । তার থেকে অনুপ্রেরণা যত পেয়েছি, আমার স্বপ্নে ও কল্প সৃষ্টিতে প্রতিদানও দিয়েছি তেমনি । নিয়তির দুর্বোধ্যলীলায় এই নিঃসঙ্গ কবিকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল এশিয়া ও পশ্চিম মহাদেশের বড়ো বড়ো দেশগুলিতে সহস্ৰ লোকচক্ষুর উজ্জ্বল দৃষ্টির মাঝখানে । তথাপি সে-সব জায়গায় যে-সকল বাণী ও যে-সমান্ত অভিভাষণ। আমাকে দিতে হয়েছিল আমার সত্যিকারের ভাষা সেখানকার নয়, সে আছে আমার সৃষ্টিনিরত আত্মার গভীরে- যেখানে আমার চিন্তারাজি বাক্য হারিয়ে ঘুরে বেরিয়েছে সেইখানে । যদি আজ আপনাদের দেশে না আসতাম। তবে আমার তীর্থযাত্রা অসম্পূর্ণ থেকে যেত। আজ আপনাদের দেখা পেয়ে নির্মল আনন্দে আমার জীবনের এই সন্ধ্যা কানায় কানায় ভরে উঠেছে । যে প্ৰেমসূত্রের নিদর্শন আজকের এই সভা, সেই প্ৰেমসূত্রে প্রাচ্যের এই দুটি প্রাচীন সভ্যতাকে মিলিত করতে পেরে আজ আমি ধন্য ।