পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৪৩২ রবীন্দ্র-রচনাবলী বড়োত্বের গোরস্থান করিয়া রাখিতে পারি না। যাহা চিরজীবী তাঁহাই থাক্‌ ; ৷ যাহা মৃতদেহ, আজ বাদে কাল কীটের খাদ্য হইবে, তাহাকে মুগ্ধ স্নেহে ধরিয়া রাখিবার চেষ্টা না করিয়াই শোকের সহিত, অথচ বৈরাগ্যের সহিত, শ্মশানে ভস্ম করিয়া আসাই বিহিত। পাছে ভূলি, এই আশঙ্কায় নিজেকে উত্তেজিত রাখিবার জন্ত কল বানাইবার চেয়ে ভোলাই ভালো। ঈশ্বর আমাদিগকে দয়া করিয়াই বিস্মরণশক্তি দিয়াছেন। সঞ্চয় নিতান্ত অধিক হইয়া উঠিতে থাকিলে বাছাই করা দুঃসাধ্য হয়। তাহা ছাড়া সঞ্চয়ের নেশা বড়ো দুৰ্জয় নেশা। এক বার যদি হাতে কিছু জমিয়া যায়, তবে জমাইবার ঝোক আর সামলানো যায় না। আমাদের দেশে ইহাকেই বলে নিরানব্বইয়ের ধাক্কা । যুরোপ এক বার বড়োলোক জমাইতে আরম্ভ করিয়া এই নিরানব্বইয়ের আবর্তের মধ্যে পড়িয়া গেছে। যুরোপে দেখিতে পাই কেহ বা ডাকের টিকিট জমায়, কেহ বা দেশলাইয়ের বাক্সের কাগজের আচ্ছাদন জমায়, কেহ বা পুরাতন জুতা কেহ বা বিজ্ঞাপনের ছবি জমাইতে থাকে— সেই নেশার রোখ যতই চড়িতে থাকে ততই এই সকল জিনিসের একটা কৃত্রিম মূল্য অসম্ভবরূপে বাড়িয়া উঠে। তেমনি যুরোপে মৃত বড়োলোক জমাইবার যে-একটা প্রচণ্ড নেশা আছে তাহাতে মূল্যের বিচার আর থাকে না। কাহাকেও আর বাদ দিতে ইচ্ছা করে না। যেখানে একটুমাত্র উচ্চতা বা বিশেষত্ব আছে সেইখানেই স্কুরোপ তাড়াতাড়ি সিন্ধুর মাখাইয়া দিয়া ঘণ্টা নাড়িতে থাকে। দেখিতে দেখিতে দল জুটিয়া যায়। বস্তুত মাহীত্ম্যের সঙ্গে ক্ষমতা বা প্রতিভার প্রভেদ আছে। মহাত্মারা আমাদের কাছে এমন একটি আদর্শ রাখিয়া যান, যাহাতে র্তাহাদিগকে ভক্তিভরে স্মরণ করিলে জীবন মহত্ত্বের পথে আকৃষ্ট হয়, কিন্তু ক্ষমতাশালীকে স্মরণ করিয়া আমরা যে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হইতে পারি তাহা নহে। ভক্তিভাবে শেকসপিয়রের স্মরণমাত্র আমাদিগকে শেক্সপিয়রের গুণের অধিকারী করে না, কিন্তু যথার্থভাবে কোনো সাধুকে অথবা বীরকে স্মরণ করিলে আমাদের পক্ষে সাধুত্ব বা বীরত্ব কিয়ৎপরিমাণেও সরল হইয়া আসে । তবে গুণিসম্বন্ধে আমাদের কী কর্তব্য ? গুণীকে তাহার গুণের দ্বার স্মরণ করাই আমাদের স্বাভাবিক কর্তব্য। শ্রদ্ধার সহিত তানসেনের গানের চর্চা করিয়াই গুণমুগ্ধ গায়কগণ তানসেনকে যথার্থভাবে স্মরণ করে। ধ্রুপদ শুনিলে যাহার গায়ে জর আসে লেও তানসেনের প্রতিম গড়িবার জন্য চাদ দিয়া ঐহিক পারগ্রিক কোনো ফললাত