পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

839 রবীন্দ্র-রচনাবলী সাগরের কারুণ্য বলিষ্ঠ, পুরুষোচিত, এইজন্ত তাহ সরল এবং নির্ষিকার ; তাহ কোথাও স্বল্প তর্ক তুলিত না, নাসিকাকুঞ্চন করিত না, বসন তুলিয়া ধরিত না— একেবারে দ্রুতপদে, ঋজু রেখায়, নি:শঙ্কে, নিঃসংকোচে আপন কার্ধে গিয়া প্রবৃত্ত হইত। রোগের বীভৎস মলিনতা তাহাকে কখনো রোগীর নিকট হইতে দূরে রাখে নাই। এমন-কি, চণ্ডীচরণবাবুর গ্রন্থে লিখিত আছে, কার্মাটাড়ে এক মেথরজাতীয় স্ত্রীলোক ওলাউঠায় আক্রান্ত হইলে বিদ্যাসাগর স্বয়ং তাহার কুটিরে উপস্থিত থাকিয়া স্বহস্তে তাহার সেবা করিতে কুষ্ঠিত হন নাই। বর্ধমান-বাস-কালে তিনি তাহার প্রতিবেশী দরিদ্র মুসলমানগণকে আত্মীয়নির্বিশেষে যত্ন করিয়াছিলেন। ঐযুক্ত শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ব মহাশয় তাহার সহোদরের জীবনচরিতে লিখিতেছেন— ‘অন্নসত্রে ভোজনকারিণী স্ত্রীলোকদের মস্তকের কেশগুলি তৈলাভাবে বিরূপ দেখাইত। অগ্রজ মহাশয় তাহ অবলোকন করিয়া দুঃখিত হইয়া তৈলের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন, প্রত্যেককে দুই পলা করিয়া তৈল দেওয়া হইত। যাহারা তৈল বিতরণ করিত, তাহার, পাছে মুচি, হাড়ী, ডোম প্রভৃতি অপকৃষ্ট জাতীয় স্ত্রীলোক স্পর্শ করে, এই আশঙ্কায় তফাৎ হইতে তৈল দিত, ইহা দেখিয়া অগ্রজ মহাশয় স্বয়ং উক্ত অপকৃষ্ট ও অস্পৃশ্ব জাতীয় স্ত্রীলোকদের মস্তকে তৈল মাখাইয়া দিতেন। এই ঘটনাশ্রবণে আমাদের হৃদয় যে ভক্তিতে উচ্ছসিত হইয় উঠে তাহ বিদ্যাসাগরের দয়া অনুভব করিয়া নহে। কিন্তু তাহার দয়ার মধ্য হইতে যে-একটি নিসংকোচ বলিষ্ঠ মচুন্যত্ব পরিস্ফুট হইয় উঠে তাহ দেখিয়া, আমাদের এই নীচজাতির প্রতি চিরাভ্যস্ত-স্বণা-প্রবণ মনও আপন নিগৃঢ়মানবধর্মবশত ভক্তিতে আকৃষ্ট না হইয়া থাকিতে পারে না । র্তাহার কারুণ্যের মধ্যে যে পৌরুষের লক্ষণ ছিল তাহার অনেক উদাহরণ দেখা যায়। আমাদের দেশে আমরা ধাহাদিগকে ভালোমানুষ অমায়িকপ্রকৃতি বলিয়া প্রশংসা করি, সাধারণত তাহদের চক্ষুলজা বেশি। অর্থাৎ কর্তব্যস্থলে তাহারা কাহাকেও বেদন দিতে পারেন না। বিদ্যাসাগরের দয়ায় সেই কাপুরুষতা ছিল না। ঈশ্বরচন্দ্র যখন কলেজের ছাত্র ছিলেন তখন তাহায়ের বেদান্ত-অধ্যাপক শম্ভুচন্ত্র বোচস্পতির সহিত র্তাহার বিশেষ প্রতিবন্ধন ছিল। বাচস্পতিমহাশয় বৃদ্ধবয়সে পুনরায় দারপরিগ্রহ করিবার ইচ্ছা করিয়ার্তাহার প্রিয়তম ছাত্রের মত জিজ্ঞাসা করিলে ঈশ্বরচন্দ্র প্রবল আপত্তিপ্রকাশ করিলেন। গুরু বারংবার কাকুতিমিনতি করা সত্বেও তিনি মতপরিবর্তন করিলেন না। তখন বাচস্পতিমহাশয় ঈশ্বরচন্দ্রের নিষেধে কৰ্ণপাত নী করিয়া এক স্বন্দরী বালিকাকে বিবাহপূর্বক তাহাকে জাপ্ত বৈধব্যের তটদেশে জানয়ন