পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চারিত্রপূজা 933 সকল এরূপ কলুষিত হইয়া গিয়াছে ও অভিভূত হইয়া রহিয়াছে যে, হতভাগা বিধবাদিগের দুরবস্থা দর্শনে, তোমাদের চিরপ্তক নীরস হৃদয়ে কারুণ্য রসের সঞ্চার হওয়া কঠিন এবং ব্যভিচার দোষের ও ভ্রুণহত্যা পাপের প্রবল স্রোতে দেশ উচ্ছলিত হইতে দেখিয়াও, মনে স্বর্ণার উদয় হওয়া অসম্ভাবিত। তোমরা প্রাণত্যুল্য কস্তা প্রভৃতিকে অসহ বৈধব্যযন্ত্রণানলে দগ্ধ করিতে সন্মত জাছ ; তাহারা দুৰ্নিবার-রিপু বশীভূত হইয়া, ব্যভিচারদোষে দূষিত হইলে, তাহার পোষকতা করিতে সম্মত আছ ; ধৰ্ম্মলোপভয়ে জলাঞ্জলি দিয়া, কেবল লোকলজাভয়ে, তাহীদের ভ্রুণহত্যার সহায়তা করিয়া, স্বয়ং সপরিবারে পাপপক্ষে কলঙ্কিত হইতে সন্মত আছ ; কিন্তু, কি আশ্চৰ্য্য | শাস্ত্রের বিধি অবলম্বন পূর্বক, তাহাদের পুনরায় বিবাহ দিয়া, তাহাদিগকে দুঃসহ বৈধব্য যন্ত্রণা হইতে পরিত্রাণ করিতে এবং আপনাদিগকেও সকল বিপদ হইতে মুক্ত করিতে সম্মত নহ। তোমরা মনে কর, পতিবিয়োগ হইলেই, স্ত্রীজাতির শরীর পাষাণময় হইয়া যায় ; দুঃখ আর দুঃখ বলিয়া বোধ হয় না ; যন্ত্রণ আর যন্ত্ৰণ বলিয়া বোধ হয় না ; দুর্জয় রিপুর্বর্গ এককালে নিৰ্ম্মল হইয়া যায়। কিন্তু, তোমাদের এই সিদ্ধান্ত ষে নিতান্ত ভ্রাস্তিমূলক, পদে পদে তাহার উদাহরণ প্রাপ্ত হইতেছ। ভাবিয়া দেখ, এই অনবধানদোষে, সংসারতরুর কি বিষময় ফল ভোগ করিতেছ।’ রমণীর দেবীত্ব ও বালিকার ব্রহ্মচর্ধমাহাজ্যের সম্বন্ধে বিদ্যাসাগর আকাশগামী ভাবুকতার ভূরিপরিমাণ সজল বাষ্প স্বষ্টি করিতে বসেন নাই ; তিনি তাহার পরিষ্কার সবল বুদ্ধি ও সরল সহৃদয়তা লইয়া সমাজের যথার্থ অবস্থা ও প্রকৃত বেদনায় সকরুণ হস্তক্ষেপ করিয়াছেন। কেবলমাত্র মধুর বাক্যরসে চিড়াকে সরস করিতে সেই চায় বাহার দধি নাই। কিন্তু বিদ্যাসাগরের দধির অভাব না থাকাতে বাকপটুতার প্রয়োজন হয় নাই। দয়া আপনি দুঃখের স্থানে গিয়া আকৃষ্ট হয়। বিদ্যাসাগর স্পষ্ট দেখিতেছেন যে, প্রকৃত সংসারে বিধবা হইবামাত্র বালিকা হঠাৎ দেবী হইয় উঠে না, এবং জামরাও তাহার চতুর্দিকে নিষ্কলঙ্ক দেবলোক স্বষ্টি করিয়া বসিয়া নাই ; এমন অবস্থায় সেও দুঃখ পায়, সমাজেরও রাশি রাশি অমঙ্গল ঘটে, ইহা প্রতিদিনের প্রত্যক্ষ সত্য। সেই দুঃখ সেই অকল্যাণ -নিবারণের উপযুক্ত উপায় অবলম্বন না করিয়া বিদ্যাসাগর থাকিতে পারেন না। আমরা সে স্থলে স্বনিপুণ কাব্যকলা-প্রয়োগপূর্বক একটা স্বকপোলকল্পিত জগতের আদর্শ বৈধব্য কল্পনা করিয়া তৃপ্তিলাভ করি। কারণ, তাহার সবল ধর্মবুদ্ধিতে তিনি সহজেই ৰে বেনা বোধ করিয়াছেন আমরা সেই বেদন ৰখাখরুপে হৃদয়ের মধ্যে অনুভব করি না। সেইজন্স এ সম্বন্ধে আমাদের রচনায় নৈপুণ্য প্রকাশ পায়, সরলতা প্রকাশ পায় না। যথার্থ সবলতার সঙ্গে সঙ্গেই