পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চারিত্রপূজা & Sæ আলোক জালাইয়া দিলেন, কিন্তু চিতালোক তো জালান নাই। ইহাই রামমোহন রায়ের প্রধান মহত্ব। কেবলমাত্র বাহ অনুষ্ঠান ও জীবনহীন তন্ত্রমন্ত্রের মধ্যে জীবস্তে সমাহিত হিন্দুধর্মের পুনরুদ্ধার করিলেন। যে মৃতভারে আচ্ছন্ন হইয়া হিন্দুধর্ম দিন দিন অবসর মুমূর্ধ হইয় পড়িতেছিল, যে জড়পাষাণগুপে পিষ্ট হইয়। হিন্দুধর্মের হৃদয় হতচেতন হইয়া পড়িতেছিল, সেই মৃতভারে, সেই জড়ভূপে, রামমোহন রায় প্রচও বলে আঘাত করিলেন– তাহার ভিত্তি কম্পিত হইয়া উঠিল— তাহার আপাদমস্তক বিদীর্ণ হইয়া গেল। হিন্দুধর্মের বিপুলায়তন প্রাচীন মন্দির জীর্ণ হইয়া প্রতিদিন ভাঙিয়া পড়িতেছিল, অবশেষে হিন্দুধর্মের দেবপ্রতিমা আর দেখা যাইতেছিল না, কেবল মন্দিরেরই কাষ্ঠলোষ্ট্রধূলিস্তপ অত্যন্ত উচ্চ হইয়া উঠিয়াছিল। তাহার গর্তের মধ্যে অন্ধকার ঘনীভূত হইতেছিল, ছোটোবড়ো নানাবিধ সরীস্বপগণ গুহা নির্মাণ করিতেছিল, তাহার ইতস্তত প্রতিদিন কণ্টকাকীর্ণ গুল্মসকল উদ্ভিন্ন হইয়া সহস্ৰ শিকড়ের দ্বারা নূতন নূতন বন্ধনে সেই পুরাতন ভগ্নাবশেষকে একত্রে বাধিয়া রাখিতে চেষ্টা করিতেছিল। হিন্দুসমাজ দেবপ্রতিমাকে ভুলিয়া এই জড়স্তৃপকে পূজা করিতেছিল ও পর্বতপ্রমাণ জড়ত্বের তলে পড়িয়া প্রতিদিন চেতনা হারাইতেছিল । রামমোহন রায় সেই ভগ্নমন্দির ভাঙিলেন। সকলে বলিল, তিনি হিন্দুধর্মের উপরে আঘাত করিলেন। কিন্তু তিনিই হিন্দুধর্মের জীবন রক্ষা করিলেন। সমস্ত ভারতবর্ষ এইজন্ত র্তাহার নিকটে কৃতজ্ঞ। কী সংকটের সময়েই তিনি জন্সিয়াছিলেন । তাহার এক দিকে হিন্দুসমাজের তটভূমি জীর্ণ হইয়া পড়িতেছিল, আর-এক দিকে বিদেশীয় সভ্যতাসাগরের প্রচণ্ড বন্ত বিদ্যুং-বেগে অগ্রসর হইতেছিল— রামমোহন রায় উtহার অটল মহত্ত্বে মাঝখানে আসিয়া দাড়াইলেন। তিনি যে বাধ নির্মাণ করিয়া দিলেন খ্ৰীষ্টীয় বিপ্লব সেখানে আসিয়া প্রতিহত হইয়া গেল। সে সময়ে তাহার মতো মহৎ লোক না জন্মাইলে এতদিন বঙ্গদেশে হিন্দুসমাজে এক অতি শোচনীয় মহাপ্লাবন উপস্থিত হইত। এইখানে রামমোহন রায়ের উদারতা সম্বন্ধে হয়তো দু-একটা কথা উঠিতে পারে। ভস্মধূপের মধ্যে ঋষিদের হৃদয়জাত যে অমর অগ্নি প্রচ্ছন্ন ছিল, ভস্ম উড়াইয়া দিয়া তিনি তাহাই বাহির করিয়াছেন। কিন্তু এত করিবার কী প্রয়োজন ছিল ? তিনি এত ভাষা জানিতেন, এত ধর্ম আলোচনা করিয়াছিলেন এবং সকল ধর্মের সত্যের প্রতিই তাহার শ্রদ্ধা ও অনুরাগ ছিল, তিনি তো বিদেশ হইতে অনায়াসে ধর্মায়ি আহরণ করিতে পারিতেন—তবে কেন তিনি সংকীর্ণতা অবলম্বন করিয়া অন্ত সকল ধর্ম ফেলিয়া ভারতবর্ষেরই ধর্ম ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত করিলেন ? তাহার উত্তর এই—