পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

७8७ রবীন্দ্র-রচনাবলী । কথাটা সর্বত্রই রাষ্ট্র হয়ে গেছে। ও আর কিছুতে ঢাকা রইল না। এই দেখে-না হিন্দুপ্রকাশে কী লিখেছে। ওরে তিনকড়ে, চট করে সেই কাগজখানা নিয়ে আয় তো। এই দেখে- 'কলিযুগের ভগীরথ এবং ফজুগঞ্জের ভাগীরথী।- লোকটার রচনাশক্তি দিব্য আছে। আর সেই পরশুদিনকার বঙ্গতোষিণীখানা আন দেখি, তাতেও বড়ো বড়ো দুখন চিঠি বেরিয়েছে। কী ? খুঁজে পাচ্ছিস নে ? হারিয়েছিস বুঝি ? হারায় যদি তো তোর দুখানা হাড় আন্ত রাখব না, তা জনিস ! সেদিন যে তোর হাতে দিয়ে বলে দিলুম আলমারির ভিতর তুলে রেখে দিস ! পাঁজি বেটা ! নচ্ছার বেটা ! হারামজাদা বেটা ! কোথায় আমার কাগজ হারালি বের করে দে ! দে বের করে ! যেখান থেকে পাস নিয়ে আয়, নইলে তোকে পুঁতে ফেলব বেটা !— ওঃ, তাই বটে, আমার ক্যাশবাক্সের ভিতরে তুলে রেখেছিলুম। ওহে হরিভুষণ, পড়ে শুনিয়ে দাও তো, আমার আবার বাংলা পড়াটা ভালো অভ্যোস নেই।- কে গা ? মতি গয়লানী বুঝি ? তা, এসো এসো, আমি পায়ের ধুলো দিচ্ছি- দুধের দাম নিতে এসেছ ? এখনো শোন নি বুঝি ? নন্দ মুকুজেকে মা গঙ্গা কী স্বপন দিয়েছেন সে-সব খবর রাখ না ? বেট, তুই আমার পুকুরের জল দুধের সঙ্গে মিশিয়ে আমাকে বিক্রি করেছিস, সে জলের মহাত্ম্য জানিস ? কেমন, সবার কাছে কথাটা শুনলি তো ? এখন হিসেবটা রেখে পায়ের ধুলো নিয়ে আমার খিড়কির ঘাটে চট করে একটা ডুব দিয়ে আয় গে যা। এই এখনই যাচ্ছি। বেলা হয়েছে সে কি আর জানি নে ? ভাত ঠাণ্ডা হয়ে গেল ? তা, কী করব বলো। লোকজন সব অনেক দূর থেকে একটু পায়ের ধুলোর প্রত্যাশায় এসেছে, এরা কি সব নিরাশ হয়ে যাবে !! আচ্ছা, উঠি । ওরে তিনকড়ে, তুই এখানে হাজির থাকিস— যারা আমাকে দেখতে আসবে সব বসিয়ে রাখিস, আমি এলুম বলে। খবরদার ! দেখিস যেন কেউ দর্শন না পেয়ে ফিরে না যায়। বলিস ভগীরথী-ঠাকুরের ভোগ হচ্ছে। বুঝলি ? আমি দুটাে ভাত মুখে দিয়েই এলুম বলে। রোধে, তুই যে একেবারে সিধে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে রইলি ! তোর কি মাথা নোয় না নাকি ? তোর তো ভারি অহংকার দেখছি। বেটা, তোর ভক্তির লেশমাত্র নেই। পাঁজি বেটা, তোকে জুতো মেরে বিদায় করে দেব তা জানিস ? সবাই আমাকে ভক্তি করছে, আর তুই বেটা এতবড়ো খ্ৰীস্টান হয়েছিস যে, আমাকে দেখে প্ৰণাম করিস নে ! তোর পরকালের ভয় নেই ? বোরো আমার বাড়ি থেকে । ছি বাবা উমেশা, তোমার এত বয়স হল, তবুকার সঙ্গে কিরকম ব্যবহার করতে হয়। শিখলে না ? যে ভগীরথ মর্তে গঙ্গা এনেছিলেন তঁর গল্প মহাভারতে পড়েছ তো ? ভুল করছ- ঐরাবত নয়, সে ভগীরথ । আমাকে সেই ভগীরথ বলে জেনো । বুঝেছ ? মনে থাকবে তো ? ভগীরথ, ঐরাবত নয়। সেই জায়গাটা মাস্টারের কাছে পড়ে নিয়ে । এসো বাবা, তোমার মাথায় পায়ের ধুলো দিয়ে দিই। কই ? ভাত কই ? আমি আর সবুর করতে পারছি নে- দেশ-দেশান্তর থেকে সব লোক আসছে। কী গো গিন্নি, এত রাগ কিসের ? হয়েছে কী ? খিড়কির পুকুরে লোকজনের ভিড় হয়েছে ? নাওয়া, কাপড় কাচা, বাসন মাজা, জল তোলা, সমস্ত বন্ধ হয়েছে ? কী করব বলে। আমি স্বয়ং ভগীরথ হয়ে গঙ্গা থেকে তো কাউকে বঞ্চিত করতে পারি নে। তা হলে আমি এত তপিস্যে করে এত কষ্ট করে গঙ্গা আনলুম কেন ? তোমাদের ময়লা কাপড় কাঁচবার জন্যে— বটে ! যখন ব্ৰাহ্মণের সঙ্গে মকদ্দমা করছিলুম তখন তােমরা সেই আশায় বসেছিলে, আসল কথাটা কেবল আমি জানতুম আর মা গঙ্গাই জানতেন — কী ! এতবড়ো আস্পর্ধ-তুই বিশ্বাস করিস নে ! জানিস, তােকে বিয়ে করে তাের চােদপুরুষকে উদ্ধার করেছি। বাপের বাড়ি যাবে ? যাও-না ! মরবার সময় আমার এই গঙ্গায় আসতে দেব না। সেটা মনে রেখাে। ভাত আর আছে তো ? নেই ? আমি যে তোমাকে বেশি করে রাঁধতে বলে দিয়েছিলুম। আমার প্রসাদ নিয়ে যাবে বলে যে দেশ-বিদেশ থেকে লোক এসেছে। যা রেখেছ, এর একটা একটা ভাত খুঁটে দিলেও যে কুলোবে না। রান্নাঘরে যত ভাত আছে সব নিয়ে এসোতোমরা সব চিড়ে আনতে দাও, পুকুর থেকে গঙ্গাজল এনে ভিজিয়ে খেয়ো। কী করব বলে। দূর থেকে নাম শুনে প্রসাদ নিতে এসেছে, তাদের ফেরাতে পারব না। কী বললে ? আমার হাতে পড়ে তোমার হাড় জ্বালাতন হয়ে গেল ? কী বলব, তুমি মুধু মেয়েমানুষ, ঐ কথাটা একবার দেশের ভালো