পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চতুরঙ্গ 800 হরিমোহন শচীশের মেসে গিয়া উপস্থিত হইলেন। তাহাকে নিভৃতে ডাকিয়া লইয়া কহিলেন, এ কী শুনি ! তোর কি মরিবার আর জায়গা জুটিল না ? এমন করিয়া কুলে কলঙ্ক দিতে বসিলি! শচীশ বলিল, কুলের কলঙ্ক মুছিবার জন্যই আমার এই চেষ্টা, নহিলে বিবাহ করিবার শখ আমার হরিমোহন কহিলেন, তোর কি ধৰ্মজ্ঞান একটুও নাই ? ঐ মেয়েটা তোর দাদার স্ত্রীর মতে, উহাকে श्- . শচীশ বাধা দিয়া বলিয়া উঠিল, স্ত্রীর মতো ! এমন কথা মুখে উচ্চারণ করবেন না। ইহার পরে হরিমোহন যা মুখে আসিল তাই বলিয়া শচীশকে গাল পাড়িতে লাগিলেন। শচীশ কোনো উত্তর করিল না । হরিমোহনের বিপদ ঘটিয়াছে এই যে, পুরন্দর নির্লজের মতো বলিয়া বেড়াইতেছে যে, শচীশ যদি | ননিকে বিবাহ করে তবে সে আত্মহত্যা করিয়া মরিবে । পুরন্দরের স্ত্রী বলিতেছে, তাহা হইলে তাে আপদ চোকে, কিন্তু সে তোমার ক্ষমতায় কুলাইবে না। হরিমোহন পুরন্দরের এই শাসনি সম্পূর্ণ যে বিশ্বাস করেন তা নয়, অথচ তীর ভয়ও যায় না । শচীশ এতদিন ননিকে এড়াইয়া চলিত ; একলা তো একদিনও দেখা হয় নাই, তার সঙ্গে দুটা কথা হইয়াছে কি না সন্দেহ। বিবাহের কথা যখন পাকাপাকি ঠিক হইয়া গেছে তখন জগমোহন শচীশকে বলিলেন, বিবাহের পূর্বে নিরালায় একদিন ননির সঙ্গে ভালো করিয়া কথাবার্তা কহিয়া লও, একবার দুজনের মন-জানাজানি হওয়া দরকার। * শচীশ রাজি হইল । জগমোহন দিন ঠিক করিয়া দিলেন । ননিকে বলিলেন, মা, আমার মনের মতো করিয়া আজ কিন্তু তোমাকে সাজিতে হইবে । ননি লজ্জায় মুখ নিচু করিল। না। মা, লজা করিলে চলিবে না, আমার বড়ো মনের সাধ, আজ তোমার সাজ দেখিব- এ তোমাকে পুরাইতে হইবে। এই বলিয়া চুমকি-দেওয়া বেনরসি শাড়ি, জামা ও ওড়না, যা তিনি নিজে পছন্দ করিয়া কিনিয়া আনিয়াছিলেন, ননির হাতে দিলেন । ܀ ননি গড় হইয়া পায়ের ধূলা লইয়া তঁহাকে প্ৰণাম করিল। তিনি ব্যস্ত হইয়া পা সরাইয়া লইয়া কহিলেন, এতদিনে তবু তোমার ভক্তি ঘোচাইতে পারিলাম না! আমি নাহয় বয়সেই বড়ো হইলাম, কিন্তু মা, তুমি যে মা বলিয়া আমার বড়ো। এই বলিয়া তার মস্তক চুম্বন করিয়া বলিলেন, ভবাতোষের বাড়ি আমার নিমন্ত্রণ আছে, ফিরিতে কিছু রাত হইবে । ) ননি তার হাত ধরিয়া বলিল, বাবা, তুমি আজ আমাকে আশীৰ্বাদ করে। মা, আমি স্পষ্টই দেখিতেছি। বুড়ে বয়সে তুমি এই নাস্তিককে আস্তিক করিয়া তুলিবে। আমি উইকিিপপ্লস বিশ্বাস কেরন, কিন্তু তােমার ঐ মুখখন দেখিলে আমার আশীৰ্য্য করতে করে । , . . . . বলিয়া চিবুক ধরিয়া ননির মুখটি তুলিয়া কিছুক্ষণ নীরবে তার দিকে চাহিয়া রহিলেন ; ননির দুই চক্ষু দিয়া অবিরল জল গড়াইয়া পড়িতে লাগিল। সন্ধার সময় ভবতোষের বাড়ি লোক ছুটিয়া গিয়া জগমােহনকে ডাকিয়া আনিল। তিনি আসিয়া দেখিলেন, বিছানার উপর ননির দেহ পড়িয়া আছে; তিনি যে কাপড়গুলি দিয়াছিলেন সেইগুলি পরা, হাতে একখানি চিঠি, শিয়রের কাছে শচীশ দাড়াইয়া। জগমোহন চিঠি খুলিয়া পড়িয়া দেখিলেন : বাবা, পারিলাম না, আমাকে মাপ করে । তোমার কথা ভাবিয়া এতদিন তামি প্ৰাণপণে চেষ্টা করিয়াছি, কিন্তু তাকে যে আজও ভুলিতে পারি নাই। তোমার শ্ৰীচরণে শতকোটি প্ৰণাম।