পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চতুরঙ্গ । 88S দামিনী সম্বন্ধে গােড়াকার দিকের কথাটা বলিয়া লই। পাটের ব্যবসায়ে একদিন যখন তার বাপ অন্নদাপ্রসাদের তহবিল মুনফার হঠাৎ-প্লাবনে উপচিয়া পড়িল সেই সময়ে শিবতোষের সঙ্গে দামিনীর বিবাহ। এতদিন কেবলমাত্র শিবতোষের কুল ভালো ছিল, এখন তার কপাল ভালো হইল। অন্নদা জামাইকে কলিকাতায় একটি বাড়ি এবং যাহাতে খাওয়া-পরার কষ্ট না হয় এমন সংস্থান করিয়া দিলেন । ইহার উপরে গহনাপত্র কম দেন নাই। শিবতোষকে তিনি আপনি আপিসে কাজ শিখাইবার অনেক চেষ্টা করিয়াছিলেন । কিন্তু শিবতোষের স্বভাবতই সংসারে মন ছিল না। একজন গণৎকার তাহাকে একদিন বলিয়া দিয়াছিল কোন এক বিশেষ যোগে বৃহস্পতির কোন এক বিশেষ দৃষ্টিতে সে জীবন্মুক্ত হইয়া উঠিবে। সেই দিন হইতে জীবন্মুক্তির প্রত্যাশায় সে কাঞ্চন এবং অন্যান্য রমণীয় পদার্থের লোভ পরিত্যাগ করিতে বসিল । ইতিমধ্যে লীলানন্দস্বামীর কাছে সে মন্ত্র লইল । । এ দিকে ব্যবসায়ের উলটা হাওয়ার ঝাপটা খাইয়া অন্নদার ভরা পালের ভাগ্যতরী একেবারে কত হইয়া পড়িল ৷ এখন বাড়িঘর সমস্ত বিক্রি হইয়া আহার চলা দায়। তোমাকে ডাকিতেছেন, কিছু উপদেশ দিবেন। দামিনী বলিল, না, এখন আমি যাইতে পারিব না। আমার সময় নাই । সময় নাই! শিবতোষ কাছে আসিয়া দেখিল, দামিনী অন্ধকার ঘরে বসিয়া গহনার বাক্স খুলিয়া क्षति दी जाना ल क शल नील बाद एना R 爆 এইজন্যই সময় নাই! বটে। পরদিন দামিনী লোহার সিন্ধুক খুলিয়া দেখিল তার গহনার বাক্স নাই। স্বামীকে জিজ্ঞাসা করিল, আমার গহনা ? স্বামী বলিল, সে তো তুমি তােমার গুরুকে নিবেদন করিয়াছ। সেইজন্যই তিনি ঠিক সেই সময়ে তোমাকে ডাকিয়াছিলেন, তিনি যে অন্তর্যামী ; তিনি তোমার কাঞ্চনের লোভ হরণ করিলেন । দামিনী আগুন হইয়া কহিল, দাও আমার গহনা । স্বামী জিজ্ঞাসা করিল, কেন, কী করিবে ? দামিনী কহিল, আমার বাবার দান, সে আমি আমার বাবাকে দিব । শিবতোষ কহিল, তার চেয়ে ভালো জায়গায় পড়িয়াছে। বিষয়ীর পেট না ভরাইয়া ভক্তের সেবায় তাহার উৎসর্গ হইয়াছে। এমনি করিয়া ভক্তির দস্যবৃত্তি শুরু হইল। জোর করিয়া দামিনীর মন হইতে সকল প্রকার বাসনা-কামনার ভূত ঝাড়াইবার জন্য পদে পদে ওঝার উৎপাত চলিতে লাগিল। যে সময়ে দামিনীর বাপ এবং তার ছোটাে ছোটাে ভাইরা উপবাসে মরিতেছে সেই সময়ে বাড়িতে প্রত্যহ ষাট-সত্তর জন ভক্তের সেবার অন্ন তাকে নিজের হাতে প্রস্তুত করিতে হইয়াছে। ইচ্ছা করিয়া তরকারিতে সে নুন দেয় নাই, ইচ্ছা করিয়া দুধ ধরাইয়া দিয়াছে— ‘তবু ত্বর তপস্যা এমনি করিয়া চলিতে লাগিল। এমন সময় তার স্বামী মরিবার কালে স্ত্রীর ভক্তিহীনতার শেষ দণ্ড দিয়া গেল। সমস্ত সম্পত্তি -সমেত স্ত্রীকে বিশেষভাবে গুরুর হাতে সমর্পণ করিল । ] ঘরের মধ্যে অবিশ্রাম ভক্তির ঢেউ উঠতেছে। কত দূর হইতে কত লোক আসিয়া গুরুর শরণ লাইতেছে। আর দামিনী বিনা চেষ্টায় ইহার কাছে আসিতে পারিল, অথচ সেই দুর্লভ সৌভাগ্যকে সে দিনরাত অপমান করিয়া খেদাইয়া রাখিল ! / গুরু যেদিন তাকে বিশেষ করিয়া উপদেশ দিতে ডাকিতেন সে বলিত, আমার মাথা ধরিয়াছে।