পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88s রবীন্দ্র-রচনাবলী যেদিন তাহাদের সন্ধ্যাবেলাকার আয়োজনে কোনো বিশেষ ত্রুটি লক্ষ্য করিয়া তিনি দামিনীকে প্রশ্ন করিতেন সে বলিত, আমি থিয়েটারে গিয়াছিলাম। এ উত্তরটা সত্য নহে, কিন্তু কটু । ভক্ত মেয়ের দল আসিয়া দামিনীর কাণ্ড দেখিয়া গালে হাত দিয়া বসিত। একে তো তার বেশভূষা বিধবার মতো নয়, তার পরে গুরুর উপদেশবাক্যের সে কাছ দিয়া যায় না, তার পরে এতবড়ো মহাপুরুষের এত কাছে থাকিলে আপনিই যে একটি সংযমে শুচিতায় শরীর মন আলো হইয়া ওঠে এর মধ্যে তার কোনো লক্ষণ নাই। সকলেই বলিল, ধন্যি বটে ! ঢের ঢের দেখিয়াছি কিন্তু এমন মেয়েমানুষ দেখি নাই । ভালোবাসেন । একদিন এ যখন হার মানিবে তখন এর মুখে আর কথা থাকিবে না । তিনি অত্যন্ত বেশি করিয়া ইহাকে ক্ষমা করিতে লাগিলেন । সেই রকমের ক্ষমা দামিনীর কাছে আরো বেশি অসহ্য হইতে লাগিল, কেননা তাহা যে শাসনের নামান্তর । গুরু দামিনীর সঙ্গে ব্যবহারে অতিরিক্ত ভাবে যে মাধুর্য প্রকাশ করিতেন একদিন হঠাৎ শুনিতে পাইলেন দামিনী কোনো-এক তবু তিনি বলিলেন, যা অঘটন তা ঘটবে এবং সেইটে দেখাইবার জন্যই দামিনী বিধাতার উপলক্ষ হইয়া আছে- ও বেচারার দোষ নাই । আমরা প্রথম আসিয়া কয়েক দিন দামিনীর এই অবস্থা দেখিয়ছিলাম, তার পরে অঘটন ঘটিতে শুরু হইল । আর লিখিতে ইচ্ছা হয় না— লেখাও কঠিন । জীবনের পর্দার আড়ালে অদৃশ্য হাতে বেদনার যে জাল বোনা হইতে থাকে তার নকশা কোনো শাস্ত্রের নয়, ফর্মাশের নয়— তাই তো ভিতরে বাহিরে বেমানান হইয়া এত ঘা খাইতে হয়, এত কান্না ফাটিয়া পড়ে । বিদ্রোহের কর্কশ আবরণটা কোন ভোরের আলোতে নিঃশব্দে একেবারে চৌচির হইয়া ফাটিয়া গেল, আত্মোৎসর্গের ফুলটি উপরের দিকে শিশির-ভরা মুখটি তুলিয়া ধরিল । দামিনীর সেবা এখন এমন সহজে এমন সুন্দর হইয়া উঠিল যে, তার মাধুর্যে ভক্তদের সাধনার উপরে ভক্তবৎসলের যেন বিশেষ একটি বর আসিয়া পৌছিল । এমনি করিয়া দামিনী যখন স্থির সৌদামিনী হইয়া উঠিয়াছে শচীশ তার শোভা দেখিতে লাগিল । কিন্তু আমি বলিতেছি। শচীশ কেবল শোভাই দেখিল, দামিনীকে দেখিল না । । শচীশের বসিবার ঘরে চীনামাটির ফলকের উপর লীলানন্দস্বামীর ধ্যানমূর্তির একটি ফোটােগ্রাফ ছিল । একদিন সে দেখিল, তাহা ভাঙিয়া মেজের উপরে টুকরা টুকরা হইয়া পড়িয়া আছে | শচীশ ভাবিল, তার পোষা বিড়ালটা এই কাণ্ড করিয়াছে। মাঝে মাঝে আরো এমন অনেক উপসর্গ দেখা দিতে লাগিল যা বন্য বিড়ালেরও অসাধ্য । চারি দিকের আকাশে একটা চঞ্চলতার হাওয়া উঠিল । একটা অদৃশ্য বিদ্যুৎ ভিতরে ভিতরে খেলিতে লাগিল। অন্যের কথা জানি না, ব্যথায় আমার মনটা টনটন করিতে থাকিত । এক-একবার ভাবিতম, দিনরাত্রি এই রসের তরঙ্গ আমার সহিল না— ইহার মধ্য হইতে একেবারে এক ছুটে দৌড় দিব ; সেই যে চামারদের ছেলেগুলাকে লইয়া সর্বপ্রকার রসবর্জিত বাংলা বর্ণমালার যুক্ত-অক্ষরের আলোচনা চলিত সে আমার বেশ ছিল । একদিন শীতের দুপুরবেলায় গুরু যখন বিশ্রাম করিতেছেন এবং ভক্তেরা ক্লান্ত, শচীশ কী একটা কারণে অসময়ে তার শোবার ঘরে ঢুকিতে গিয়া চৌকাটের কাছে চমকিয়া দাড়াইল । দেখিল দামিনী তার চুল এলাইয়া দিয়া মাটিতে উপুড় হইয়া পড়িয়া মেজের উপর মাথা ঠকিতেছে এবং বলিতেছে, পাথর, ওগো পাথর, ওগো পাথর, দয়া করো, দয়া করো, আমাকে মারিয়া ফেলো । ভয়ে শচীশের সর্বশরীর কঁপিয়া উঠিল, সে ছুটিয়া ফিরিয়া গেল ।