পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চতুরঙ্গ 8GS কোথায় যাইব ? তোমার মাসির ওখানে । সে আমি পারিব না । কেন ? প্ৰথম, তিনি আমার আপন মাসি নন ; তার পরে, তার কিসের দায় যে তিনি আমাকে তঁর ঘরে রাখিবেন ? যাতে তোমার খরচ তার না লাগে আমরা "তারদায় কি কেবল খরচের ? তিনি যে আমার দেখাশোনা খবরদারি করবেন সে ভার তীর উপরে নাই । আমি কি চিরদিনই সমস্তক্ষণ তোমাকে আমার সঙ্গে রাখিব ? সে জবাব কি আমার দিবার ? যদি আমি মারি তুমি কোথায় যাইবে ? সে কথা ভাবিবার ভার আমার উপর কেহ দেয় নাই। আমি ইহাই খুব করিয়া বুঝিয়াছি, আমার মা নাই, বাপ নাই, ভাই নাই ; আমার বাড়ি নাই, কড়ি নাই, কিছুই নাই। সেইজন্যই আমার ভার বড়ো বেশি ; সে ভার আপনি সাধ করিয়াই লইয়াছেন ; এ আপনি অন্যের ঘাড়ে নামাইতে পরিবেন না । এই বলিয়া দামিনী সেখান হইতে চলিয়া গেল। গুরুজি দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়িয়া বলিলেন, মধুসূদন ! একদিন আমার প্রতি দামিনীর হুকুম হইল, তার জন্য ভালো বাংলা বই কিছু আনাইয়া দিতে। বলা বাহুল্য, ভালো বই বলিতে দামিনী ভক্তিরত্নাকর বুঝত না, এবং আমার পরে তার কোনাে রকম দাবি করিতে কিছুমাত্র বাধিত না । সে একরকম করিয়া বুঝিয়া লইয়াছিল যে দাবি করাই আমার প্রতি সব চেয়ে অনুগ্রহ করা। কোনো কোনো গাছ আছে যাদের ডালপালা ছাটিয়া দিলেই থাকে ভালোদামিনীর সম্বন্ধে আমি সেই জাতের মানুষ । আমি যে লেখকের বই আনাইয়া দিলাম। সে লোকটা একেবারে নির্জলা আধুনিক। তার লেখায় মনুর চেয়ে মানবের প্রভাব অনেক বেশি প্রবল। বইয়ের প্যাকেটটা গুরুজির হাতে আসিয়া পড়িল । তিনি ভুরু তুলিয়া বলিলেন, কী হে শ্ৰীবিলাস, এ-সব বই কিসের জন্য ? আমি চুপ করিয়া রহিলাম। গুরুজি দুই-চারিটি পাতা উলটাইয়া বলিলেন, এর মধ্যে সাত্ত্বিকতার গন্ধ তো বড়ো পাই না। লেখকটিকে তিনি মোটেই পছন্দ করেন না । e আমি ফস করিয়া বলিয়া ফেলিলাম, একটু যদি মনোযোগ করিয়া দেখেন তো সত্যের গন্ধ পাইবেন । , আসল কথা, ভিতরে ভিতরে বিদ্রোহ জমিতেছিল। ভাবের নেশার অবসাদে আমি একেবারে জর্জরিত। মানুষকে ঠেলিয়া ফেলিয়া সুদ্ধমাত্র মানুষের হৃদয়বৃত্তিগুলাকে লইয়া দিনরাত্রি এমন করিয়া ঘাটাঘাটি করিতে আমার যতদূর অরুচি হইবার তা হইয়াছে। , গুরুজি আমার মুখের দিকে খানিকক্ষণ চাহিয়া রহিলেন, তার পরে বলিলেন, আচ্ছা, তবে একবার মনোযোগ করিয়া দেখা যাক। বলিয়া বইগুলা তীর বালিশের নীচে রাখিলেন। বুঝিলাম, এ তিনি ফিরাইয়া দিতে চান না । ጳ নিশ্চয় দামিনী আড়াল হইতে ব্যাপারখানার আভাস পাইয়াছিল। দরজার কাছে আসিয়া সে আমাকে বলিল, আপনাকে যে বইগুলা আনাইয়া দিতে বলিয়ছিলাম সে কি এখনো আসে নাই ? আমি চুপ করিয়া রহিলাম। : রুজি বলিলেন, মা, সে বইগুলি তো তোমার পড়বার যোগ্য নয়। দামিনী কহিল, আপনি বুঝিবেন কী করিয়া ? ? গুরুজি ভুকুঞ্চিত করিয়া বলিলেন, তুমিই বা বুঝিবে কী করিয়া ?