পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চতুরঙ্গ 8(? ひ (? পাথর আবার গলিল। দামিনীর যে অসহ্য দীপ্তি ছিল তার আলোটুকু রহিল, তাপ রহিল না । পূজায় অৰ্চনায় সেবায় মাধুর্যের ফুল ফুটিয়া উঠিল। যখন কীর্তনের আসর জমিত, গুরুজি আমাদের লইয়া যখন আলোচনায় বসিতেন, যখন তিনি গীতা বা ভাগবত ব্যাখ্যা করিতেন, দামিনী কখনো একদিনের জন্য অনুপস্থিত থাকিত না । তার সাজসজ্জারও বদল হইয়া গেল ! আবার সে তার তসরের কাপড়খানি পরিল ; দিনের মধ্যে যখনই তাকে দেখা গেল মনে হইল সে যেন এইমাত্র স্নান করিয়া আসিয়াছে । গুরুজির সঙ্গে ব্যবহারেই তার সকলের চেয়ে কঠিন পরীক্ষা । সেখানে সে যখন নত হইত। তখন তার চোখের কোণে আমি একটা রুদ্র তেজের ঝলক দেখিতে পাইতাম ; আমি বেশ জানি, গুরুজির কোনো হুকুম সে মনের মধ্যে একটুও সহিতে পারে না, কিন্তু তার সব কথা সে এতদূর একান্ত করিয়া মানিয়া লইল যে, একদিন তিনি তাকে বাংলার সেই বিষম আধুনিক লেখকের দুর্বিষহ রচনার বিরুদ্ধে সাহস করিয়া আপত্তি জানাইতে পারিলেন । পরের দিন দেখিলেন, তার দিনে বিশ্রাম করিবার বিছানার কাছে কতকগুলা ফুল বহিয়াছে, ফুলগুলি সেই লোকটার বইয়ের ছেড়া পাতার উপরে সাজানো । অনেক বার দেখিয়াছি গুরুজি শচীশকে যখন নিজের সেবায় ডাকিতেন। সেইটেই দামিনীর কাছে সব চেয়ে অসহ্য ঠেকিত । সে কোনোমতে ঠেলিয়া-ঠলিয়া শচীশের কাজ নিজে করিয়া দিতে চেষ্টা করিত, কিন্তু সব সময়ে তাহা সম্ভব হইতে না । তাই শচীশ যখন গুরুজির কলিকায় ফু দিতে থাকিত তখন দামিনী ॐ'6'°78 7: // জাপিত, অপরাধ করিব না, অপরাধ করিব ୩ । কিন্তু শচীশ যাহা ভাবিয়ছিল তার কিছুই হইল না ; আর-একবার দামিনী যখন এমনি করিয়াই নত হইয়াছিল তখন শচীশ তার মধ্যে কেবল মাধুর্যকেই দেখিয়াছিল, মধুরীকে দেখে নাই । এবারে স্বয়ং দামিনী তার কাছে এমনি সতী হইয়া উঠিয়াছে যে গানের পদ, তত্ত্বের উপদেশ সমস্তকে ঠেলিয়া সে দেখা দেয়, কিছুতেই তাকে চাপা দেওয়া চলে না । শচীশ তাকে এতই স্পষ্ট দেখিতে পায় যে, তার ভাবের ঘোর ভাঙিয়া যায় । এখন সে তাকে কোনোমতেই একটা ভাবরসের রূপকমাত্র বলিয়া মনে করিতে পারে না ; এখন দামিনী গানগুলিকে সাজায় না, গানগুলিই দামিনীকে সাজাইয়া তোলে | এখানে এই সামানা কথাটুকু বলিয়া রাখি, এখন আমাকে দামিনীর আর কোনো প্রয়োজন নাই । আমার পরে তার সমস্ত ফর্মােশ হঠাৎ একেবারে বন্ধ | আমার যে কয়েকটি সহযোগী ছিল তার মধ্যে চিলটো মরিয়াছে, বেজিটা পালাইয়াছে, কুকুর-ছানাটার অনাচারে গুরুজি বিরক্ত বলিয়া সেটাকে দামিনী বিলাইয়া দিয়াছে ! এইরূপে আমি বেকার ও সঙ্গীহীন হইয়া পড়াতে পুনশ্চ গুরুজির দরবারে পূর্বের মতো ভর্তি হইলাম, যদিচ সেখানকার সমস্ত কথাবার্তা গানবাজনা আমার কাছে একেবারে বিশ্ৰী wi. রকমের বিস্বাদ হইয়া গিয়াছিল । や একদিন শচীশ কল্পনার খোলা-ভাটিতে পূর্ব ও পশ্চিমের, অতীতের ও বর্তমানের সমস্ত দর্শন ও বিজ্ঞান, রস ও তত্ত্ব একত্র চোলাইয়া একটা অপূর্ব আরক বানাইতেছিল, এমন সময়ে হঠাৎ দামিনী ছুটিয়া আসিয়া বলিল, ওগো, তোমরা একবার শীঘ্র এসো | আমি তাড়াতাড়ি উঠিয়া বলিলাম, কী হইয়াছে ? দামিনী কহিল, নবীনের স্ত্রী বোধ হয় বিষ খাইয়াছে । নবীন আমাদের গুরুজির একজন চেলার আত্মীয়- আমাদের প্রতিবেশী, সে আমাদের কীর্তনের দলের একজন গায়ক । গিয়া দেখিলাম, তার স্ত্রী তখন মরিয়া গেছে। খবর লইয়া জানিলাম, নবীনের স্ত্রী তার মাতৃহীনা বােনকে নিজের কাছে আনিয়া রাখিয়াছিল। ইহারা কুলীন, উপযুক্ত পােত্র পাওয়া দায় । মেয়েটিকে দেখিতে ভালো। নবীনের ছােটাে ভাই তাকে বিবাহ করবে বলিয়া পছন্দ করিয়াছে।