পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8(? ど রবীন্দ্র-রচনাবলী শ্ৰীবিলাস S এখানে এক সময়ে নীলকুঠি ছিল । তার সমস্ত ভাঙিয়াচুরিয়া গেছে, কেবল গুটিকতক ঘর বাকি । কিছুদিনের জন্য এখানে রহিয়া গেলাম । নদী হইতে কুঠি পর্যন্ত যে রাস্তা ছিল তার দুই ধারে শিশুগাছের সারি। বাগানে ঢুকিবার ভাঙা গেটের দুটা থাম আর পাচিলের এক দিকের খানিকটা আছে, কিন্তু বাগান নাই। থাকিবার মধ্যে এক কোণে কুঠির কোিন-এক মুসলমান গোমস্তার গোর ; তার ফাটলে ফাটলে ঘন ঝোপ করিয়া ভাটিফুলের এবং আকন্দের গাছ উঠিয়াছে, একেবারে ফুলে-ভরা— বাসরঘরে শালীর মতো মৃত্যুর কান মলিয়া দিয়া দক্ষিনা বাতাসে তারা হাসিয়া লুটােপুটি করিতেছে। দিঘির পাড় ভাঙিয়া জল শুকাইয়া গেছে । তার তলায় ধোনের সঙ্গে মিলাইয়া চাষিরা ছোলার চাষ করিয়াছে ; আমি যখন সকালবেলায় শোৎলা-পড়া ইটের ঢ়িবিটার উপরে শিশুর ছায়ায় বসিয়া থাকি তখন ধোনেফুলের গন্ধে আমার মগজ ভরিয়া যায় । বসিয়া বসিয়া ভাবি, এই নীলকুঠি, যেটা আজ গো-ভাগাড়ে গোরুর হাড়-কখানার মতো পড়িয়া আছে সে যে একদিন সজীব ছিল । সে আপনার চারি দিকে সুখদুঃখের যে ঢেউ তুলিয়াছিল মনে হইয়াছিল সে তুফান কোনোকালে শান্ত হইবে না । যে প্রচণ্ড সাহেবটা এইখানে বসিয়া হাজার হাজার গরিব চাষীর রঞ্জকে নীল করিয়া তুলিয়াছিল, তার কাছে আমি সামানা বাঙালির ছেলে কে-ই বা ! কিন্তু পৃথিবী কোমরে আপনি সবুজ আঁচলখনি আঁটিয়া বাধিয়া অনায়াসে তাকে-সুদ্ধ তার নীলকুঠি-সুদ্ধ সমস্ত বেশ করিয়া মাটি দিয়া নিছিয়া পুঁছিয়া নিকাইয়া দিয়াছে— যা একটু-আধটু সাবেক দাগ দেখা যায় আরো এক পোেচ লেপ পড়িলেই একেবারে সাফ হইয়া যাইবে । কথাটা পুরানো, আমি তার পুনরুক্তি করিতে বসি নাই ! আমার মন বলিতেছে, না গো, প্ৰভাতের |ার প্রভাতে এ কেবলমাত্র কালের উঠান-নিকানো নয় । এই নীলকুঠির সাহেবটা আর তার নীলকুঠির বিভীষিকা একটুখািন ধূলার চিহ্নের মতে মুছিয়া গেছে বটে— কিন্তু আমার দামিনী । আমি জানি, আমার কথা কেহ মানিবে না । শংকরাচার্যের মোহমুদগর কাহাকেও রেহাই করে না | মায়াময়মিদমখিলঞ্জ ইত্যাদি ইত্যাদি । কিন্তু শংকরাচার্য ছিলেন সন্ন্যাসী— কী তব কান্ত কস্তে পুত্রঃ এ-সব কথা তিনি বলিয়ছিলেন, কিন্তু এর মানে বুঝেন নাই ! আমি সন্ন্যাসী নই, তাই আমি বেশ করিয়া জানি দামিনী’ পদ্মের পাতায় শিশিরের ফোটা নয় । কিন্তু শুনিতে পাই— গৃহীরাও এমন বৈরাগ্যের কথা বলে । তা হইবে । তারা কেবলমাত্র গৃহী, তার হারায় তাদের গৃহিণীকে ! তাদের গৃহ ও মায়া বটে, তাদের গৃহিণীও তাই । ও-সব যে হাতে-গড়া আমি তো গৃহী হইবার সময় পাইলাম না ; আর সন্ন্যাসী হওয়া আমার ধাতে নাই, সেই আমার রক্ষা 1 তাই আমি যাকে কাছে পাইলাম সে গৃহিণী হইল না, সে মায়া হইল না, সে সন্তা রহিল, সে শেষ পর্যন্ত দামিনী । কার সাধ্য তাকে ছায়া বলে ? দামিনীকে যদি আমি কেবলমাত্র ঘরের গৃহিণী করিয়াই জানিতাম তবে অনেক কথা লিখিতাম না । তাকে আমি যে ই সম্বন্ধের চেয়ে বড়ো করিয়া এবং সত্য করিয়া জানিয়াছি বলিয়াই সব কথা খোলসা করিয়া লিখিতে পরিলাম, লোকে যা বলে বলুক । মায়ার সংসারে মানুষ যেমন করিয়া দিন কাটায় তেমনি করিয়া দামিনীকে লইয়া যদি আমি পুরামাত্রায় ঘরকন্না করিতে পরিতাম। তবে তেল মাখিয়া স্নান করিয়া আহারান্তে পান চিবাইয়া নিশ্চিন্ত থাকি,তাম, তবে দামিনীর মৃত্যুর পরে নিশ্বাস ছাড়িয়া বলিতাম ‘সংসারোহয়মতীব বিচিত্রঃ), এবং Ao | قد محیح ༡༡ s