পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চতুরঙ্গ 8Gs ভিতর হইতে কবিতা পায়, যে কবি নয়। সে অন্যের কােছ হইতে কবিতা নেয়। শচীশ অন্নান মুখে বলিল, আমি কবি। বাসা- চুকিয়া গেল, চলিয়া আসিলাম। শচীশের খাওয়া নাই, শোওয়া নাই, কখন কোথায় থাকে ইশ থাকে না। শরীরটা প্রতিদিনই যেন অতি-শােন-দেওয়া ছুরির মতো সূক্ষ্ম হইয়া আসিতে লাগিল। দেখিলে মনে হইত। আর সহিবে না। তবু আমি তাকে ঘটাইতে সাহস করিতাম না। কিন্তু দামিনী সহিতে পারিত না । ভগবানের উপরে সে বিষম রাগ করিত— যে তাকে ভক্তি করে না তার কাছে তিনি জব্দ, আর ভক্তের উপর দিয়াই এমন করিয়া তার শোধ তুলিতে হয় গা ? লীলানন্দস্বামীর উপর রাগ করিয়া দামিনী মাঝে মাঝে সেটা বেশ শক্ত করিয়া জানান দিত, কিন্তু ভগবানের নাগাল পাইবার উপায় ছিল না । , তবু শচীশকে সময়মত নাওয়ানো-খাওয়ানোর চেষ্টা করিতে সে ছাড়িত না। এই খাপছাড়া মনুষটাকে নিয়মে বধিবার জন্য সে যে কতরকম ফিকির ফন্দি করিত তার আর সংখ্যা ছিল না। অনেক দিন শচীশ ইহার স্পষ্ট কোনাে প্রতিবাদ করে নাই। একদিন সকালেই নদী পার হইয়া ওপারে বালুচরে সে চলিয়া গেল। সূর্য মােঝ আকাশে উঠিল, তার পরে সূর্য পশ্চিমের দিকে হেলিল, শচীশের দেখা নাই। দামিনী অভুক্ত থাকিয়া অপেক্ষা করিল, শেষে আর থাকিতে পারিল না। খাবারের থালা লইয়া হাঁটুজল ভাঙিয়া সে ওপারে গিয়া উপস্থিত। চারিদিকে ধুধু করিতেছে, জনপ্রাণীর চিহ্ন নাই। রৌদ্র যেমন নিষ্ঠুর, বালির ঢেউগুলাও তেমনি তারা যেন শূন্যতার পাহারাওয়াল, ওঁড়ি মারিয়া সব বসিয়া আছে। যেখানে কোনো ডাকের কোনো সাড়া, কোনো প্রশ্নের কোনো জবাব নাই, এমন একটা সীমানাহারা ফ্যাকাশে সাদার মাঝখানে দাড়াইয়া দামিনীর বুক দমিয়া গেল। এখানে যেন সব মুছিয়া গিয়া একেবারে গোড়ার সেই শুকনো সাদায় গিয়া পীেছিয়াছে। পায়ের তলায় কেবল পড়িয়া আছে একটা 'না'। তার না আছে শব্দ, না আছে গতি ; তাহাতে না আছে রক্তের লাল, না আছে গাছপালার সবুজ, না আছে আকাশের নীল, না আছে মাটির গেরুয়া। যেন একটা মড়ার মাথার প্রকাণ্ড ওষ্ঠ্যহীন হাসি ; মািটৰ গুপ্ত আকারে কাছে বিপুল এটা গুড় জিহ্বা মন্ত এটা স্তর দেখন্ত মিলিয়া কোন দিকে যাইবে ভাবিতেছে এমন সময় হঠাৎ বালির উপরে পায়ের দাগ চােখে পড়িল। সেই দাগ ধরিয়া চলিতে চলিতে যেখানে গিয়া সে পৌঁছিল। সেখানে একটা জলা । তার ধারে ধারে ভিজা মাটির উপরে অসংখ্য পাখির পদচিহ্ন। সেইখানে বালির পাড়ির ছায়ায় শচীশ বসিয়া | সামনের - জলটি একেবারে নীলে নীল, ধারে ধারে চঞ্চল কাদাখোচা লেজ নাচাইয়া সাদা-কালো ডানার ঝলক দিতেছে। কিছু দূরে চখ-চখীর দল ভারি গােলমাল করিতে করিতে কিছুতেই পিঠের পালক পুরাপুরি মনের মতো সাফ করিয়া উঠিতে পারিতেছে না। দামিনী পাড়ির উপর দাড়াইতেই তারা ডাকিতে ডাকিতে ডানা মেলিয়া উড়িয়া চলিয়া গেল । দামিনীকে দেখিয়া শচীশ বলিয়া উঠিল, এখানে কেন ? হঠাৎ দামিনীর মুখ দেখিয়া সে থামিয়া গেল। দামিনী আর কিছু বলিল না, থালা হাতে করিয়া জুলিয়া গেল। চার দিকে স্কুল বালি ধৰিলোকারকার বাঘের চােখের মতাে ঝকঝাক করিতে १ळ् |