পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8bro রবীন্দ্র-রচনাবলী দিয়ে গেলে তাতে তাদের মনেও সান্তনা হত, আর আমাদেরও জীবনটা কলকাতায় একটু ডালপালা মেলবার জায়গা পেত । আমার ঐখানেই গোল বেধেছিল । ওঁরা যে এতদিন আমাকে হাড়ে হাড়ে জ্বলিয়েছেন, আমার স্বামীর ভালো ওঁরা কখনো দেখতে পারেন নি— আজ কি তারই পুরস্কার পাবেন ? আর, রাজসংসার তো এইখানেই । আমাদের সমস্ত প্ৰজা-আমলা, আশ্রিত-অভ্যাগত আত্মীয়, সমস্তই এখানকার এই বাড়িকে চারি দিকে আঁকড়ে । কলকাতায় আমরা কে তা জানি নে, অন্য কজন লোকই বা জানে ! আমাদের মান-সম্মান-ঐশ্বর্যের পূর্ণ মূর্তিই এখানে । এ সমস্তই ওঁদের হাতে দিয়ে সীতা যেমন নির্বাসনে গিয়েছিলেন তেমনি করে চলে যাব । আর, ওঁরা পিছন থেকে হাসবেন ? ওঁরা কি আমার স্বামীর এ দক্ষিণ্যের মর্যাদা বোঝেন, না তার যোগ্য ওঁরা ? তার পরে যখন কোনোদিন এখানে ফিরে আসতে হবে তখন আমার আসনটি কি আর ফিরে পাব ? আমার স্বামী বলতেন, দরকার কী তোমার ঐ আসনের ? ও ছাড়াও তো জীবনের আরো অনেক আমি মনে মনে বললুম, পুরুষমানুষ এ-সব কথা ঠিক বোঝে না | সংসারটা যে কতখানি তা ওদের সম্পূর্ণ জানা নেই, সংসারের বাহির-মহলে যে ওদের বাসা । এ জায়গায় মেয়েদের বুদ্ধিমতেই ওদের চলা উচিত । সব চেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে, একটা তেজ থাকা চাই তো ; যারা চিরদিন এমন শত্ৰুতা করে এসেছেন। তাদের হাতে সমস্ত দিয়ে-থুয়ে চলে যাওয়া যে পরাভব । আমার স্বামী যদি বা তা মানতে চান আমি তো মানতে দিতে পারব না । আমি মনে মনে জানলুম, এ আমার সতীত্বের তেজ | বলেই জোর করেন নি । তিনি আমাকে বরাবর বলে এসেছেন, স্ত্রী বলেই যে তুমি আমাকে কেবলই মেনে চলবে তোমার উপর আমার এ দৌরাত্মা আমার নিজেরই সইবে না । আমি অপেক্ষা করে থাকব। আমার সঙ্গে যদি তোমার মেলে তো ভালো, যদি না মেলে তো উপায় কী ! আমার— না, এ কথা আর মুখে আনাও চলবে না । রাত্রির সঙ্গে দিনের যে তফাত সেটাকে যদি ঠিক হিসাবমত ক্ৰমে ক্ৰমে ঘোচাতে হত তা হলে সে কি কোনো যুগে ঘূচত ? কিন্তু সূর্য উঠে পড়ে, অন্ধকার চুকে যায়, অসীম কালের হিসাব মুহূর্তকালে GCG বাংলা দেশে একদিন স্বদেশীর যুগ এসেছিল, কিন্তু সে যে কেমন করে তা স্পষ্ট বোঝা যায় না । তার আগেকার সঙ্গে -এ যুগের মাঝখানকার ক্রম যেন নেই। বােধ করি সেইজন্যেই নূতন যুগ একেবারে বাধ-ভাঙা বন্যার মতো আমাদের ভয়-ভাবনা চোখের পলকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল । কী হল, কী হবে, তা বোঝবার সময় পাই নি । পাড়ায় বর আসছে, তার বঁশি বাজছে, তীখা আলো দেখা দিয়েছে, অমনি মেয়েরা যেমন ছাতে বারান্দায় জানলায় বেরিয়ে পড়ে, তাদের আবরণের দিকে আর মন থাকে না, তেমনি সেদিন সমস্ত দেশের বর আসবার বাঁশি যেমনি শোনা গেল মেয়েরা কি আর ঘরের কাজ নিয়ে চুপ করে বসে থাকতে পারে ? হুলু দিতে দিতে, শাক বাজাতে বাজাতে, তারা যেখানে দরজা জানলা দেয়ালের ফাক পেলে সেইখানেই মুখ বাড়িয়ে দিলে । সেদিন আমারও দৃষ্টি এবং চিত্ত, আশা এবং ইচ্ছা উন্মত্ত নবযুগের আবিরে লাল হয়ে উঠেছিল। এতদিন মন যে জগৎটাকে একান্ত বলে জেনেছিল এবং জীবনের ধর্মকর্ম আকাঙক্ষা ও সাধনা যে সীমাটুকুর মধ্যে বেশ গুছিয়ে সাজিয়ে সুন্দর করে তোেলবার কাজে প্রতিদিন লেগে ছিল সেদিনও তার বেড়া ভাঙে নি বটে, কিন্তু সেই বেড়ার উপরে দাড়িয়ে হঠাৎ যে একটি দূর দিগন্তের ডাক শুনলুম স্পষ্ট