পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88 রবীন্দ্র-রচনাবলী চাইতে পারে, সমস্ত প্ৰাণ দিয়ে ভোগ করতে জানে, যাদের দ্বিধা নেই, সংকোচ নেই, তারাই প্রকৃতির বরপুত্র। তাদের জন্যেই প্রকৃতি যা-কিছু সুন্দর, যা-কিছু দামি সাজিয়ে রেখেছে। তারাই নদী সীতরে আসবে, পাচিল ডিঙিয়ে পড়বে, দরজা লাথিয়ে ভাঙবে, পাবার যোগ্য জিনিস ছিনিয়ে কেড়ে নিয়ে চলে যাবে। এতেই যথার্থ আনন্দ, এতেই দামি জিনিসের দাম। প্রকৃতি আত্মসমৰ্পণ করবে, কিন্তু সে দাসুর কাছে। কেননা, চাওয়ার জোর, নেওয়ার জোর, পাওয়ার জোর সে ভোগ করতে ভালোবাসে। তাই আধমরা তপস্বীর হাড়-বের-করা গলায় সে আপনার বসন্তাফুলের স্বয়ম্বরের মালা পরাতে চায় না। নহবতখানায় রোশন'চৌকি বাজছে-লগ্ন বয়ে যায় যে, মন উদাস হয়ে গেল। বর কে ? আমিই বর। যে মশাল জ্বলিয়ে এসে পড়তে পারে বরের আসন তারই। প্রকৃতির বর আসে অনাহুত । লজ ? না, আমি লজ্জা করি নে। যা দরকার। আমি তা চেয়ে নিই, না চেয়েও নিই। লজ্জা করে যারা নেবার যোগ্য জিনিস নিলে না তারা সেই না-নেবার দুঃখটাকে চাপা দেবার জন্যেই লজাটাকে বড়ো নাম দেয়। এই-যে পৃথিবীতে আমরা এসেছি এ হচ্ছে রিয়ালিটির পৃথিবী— কতকগুলো বড়ো কথায় নিজেকে ফাকি দিয়ে খালি-পেটে খালি-হাতে যে মানুষ এই বস্তুর হাট থেকে চলে গেল সে কেন এই শক্ত মাটির পৃথিবীতে জন্মেছিল ? আশমানে আকাশকুসুমের কুঞ্জবনে কতকগুলো মিষ্ট বুলির বাধা তানে বঁাশি বাজাবার জন্যে ধর্মবিলাসী বাবুর দলের কাছ থেকে তারা বায়না নিয়েছিল নাকি ? আমার সে বঁাশির বুলিতেও দরকার নেই, আমার সে আকাশকুসুমেও পেট ভরবে না। আমি যাচাই তা আমি খুবই চাই। তা আমি দুই হাতে করে চটকাব, দুই পায়ে করে দলব, সমস্ত গায়ে তা মািখব, সমস্ত পেট ভরে তা খাব। চাইতে আমার লজ্জা নেই, পেতে আমার সংকোচ নেই। যারা নীতির উপবাসে শুকিয়ে শুকিয়ে অনেক কালের পরিত্যক্ত খাটিয়ার ছারপোকার মতো একেবারে পাতলা সাদা হয়ে গেছে তাদের চি চি গলার ভৎসনা আমার কানে পৌছবে না। : লুকোচুরি করতে আমি চাই নে, কেননা তাতে কাপুরুষতা আছে। কিন্তু দরকার হলে যদি করতে না পারি। তবে সেও কাপুরুষতা । তুমি যা চাও তা তুমি দেয়াল গেঁথে রাখতে চাও ; সুতরাং আমি যা চাই তা আমি সিদ্ধ কেটে নিতে চাই। তোমার লোভ আছে তাই তুমি দেওয়াল গাথ ; আমার লোভ আছে তাই আমি সিদ্ধ কাটি । তুমি যদি কল কর, আমি কৌশল করব। এইগুলোই হচ্ছে প্রকৃতির বাস্তব কথা। এই কথাগুলোর উপরেই পৃথিবীর রাজ্য-সাম্রাজ্য, পৃথিবীর বড়ো বড়ো কাণ্ডকারখানা চলছে। আর যে-সব অবতার স্বৰ্গ থেকে নেমে এসে সেইখানকার ভাষায় কথা কইতে থাকেন তাদের কথা বাস্তব নয়। সেইজন্যে এত চীৎকারে সে-সব কথা কেবলমাত্র দুর্বলদের ঘরের কোণে স্থান পায় ; যারা সবল হয়ে পৃথিবী শাসন করে তারা সে-সব কথা মানতে পারে না। কেননা মানতে গেলেই বলক্ষয় হয়। তার কারণ, কথাগুলো সত্যই নয়। যারা এ কথা বুঝতে দ্বিধা করে না, মানতে লজ্জা করে না, তারাই কৃতকার্য হল ; আর যে হতভাগারা এক দিকে প্রকৃতি আর-এক দিকে অবতারের উৎপাতে বাস্তব অবাস্তব দু নীেকায় পা দিয়ে দুলে মরছে তারা না পারে এগোতে, না পারে বীচিতে । এক দল মানুষ বাঁচবে না বলে প্রতিজ্ঞা করে এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে। সূর্যস্তকালের । আকাশের মতো মুমূর্খতার একটা সৌন্দৰ্য আছে, তারা তাই দেখে মুগ্ধ। আমাদের নিখিলেশ সেই জাতের জীব ; ওকে নিজীব বললেই হয় । আজ চার বৎসর আগে ওর সঙ্গে আমার এই নিয়ে একদিন ঘোর তর্ক হয়ে গেছে। ও আমাকে বলে, জোর না হলে কিছু পাওয়া যায় না। সে কথা মানি ; কিন্তু কাকে জোর বলো, আর কোনদিকে পেতে হবে তাই নিয়ে তর্ক। আমার জোর ত্যাগের দিকে জোর। আমি বললুম, অর্থাৎ লোকসানের নেশায় তুমি একেবারে মরিয়া হয়ে উঠেছ। নিখিলেশ বললে, ই, ডিমের ভিতরকার পাখি। যেমন তার ডিমের খোলাটাকে লোকসান করবার জন্যে মরিয়া হয়ে ওঠে। খােলটা খুব বাস্তব জিনিস বটে, তার বদলে সে পায় হাওয়া, পায় আলোতোমাদের মতে সে বোধ হয় ঠাকে । , নিখিলেশ এইরকম রূপক দিয়ে কথা কয় ; তার পরে আর তাকে বোঝানো শক্ত যে তৎসত্ত্বেও সেগুলো কেবলমাত্র কথা, সে সত্য নয়। তা বেশ, ও এইরকম রূপক নিয়েই সুখে থাকে তো থাক