পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 -bor সাজে-সজ্জায় ভাবে-গতিকে ভিতরের দিক থেকে একটা কেমন রঙের ছটা ফুটে উঠছিল, তার লেশমাত্র মেজো জায়ের চোখ এড়াতে পারে নি। আজ আমার এ কথা লিখতে লজ্জা হচ্ছে, কিন্তু সেদিন আমার কিছুই লজ্জা ছিল না। কেননা, সেদিন আমার সমস্ত প্রকৃতি আপনার ভিতর থেকে কাজ করছিল, কিছুই বুঝে-সুঝে করি নি। আমি জানি সেদিন আমি একটু বিশেষ সাজগোজ করতুম। কিন্তু সে যেন অন্যমনে । আমার কোন সাজ সন্দীপবাবুর বিশেষ ভালো লগত তা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারতুম। তা ছাড়া আন্দাজে বােঝবার দরকার ছিল না। সন্দীপবাবু সকলের সামনেই তার আলোচনা করতেন। তিনি আমার সামনে আমার স্বামীকে একদিন বললেন, নিখিল, যেদিন আমাদের মন্ধীরানীকে আমি প্রথম দেখলুম— সেই জরির-পড়-দেওয়া কাপড় পরে চুপ করে বসে, চোখ দুটাে যেন পথ-হারানো তারার মতো অসীমের দিকে তাকিয়ে- যেন কিসের সন্ধানে কার অপেক্ষায় অতলস্পর্শ অন্ধকারের তীরে হাজার হাজার বৎসর ধরে এইরকম করে তাকিয়ে- তখন আমার বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল- মনে হল ওঁর অন্তরের অগ্নিশিখা যেন বাইরে কাপড়ের পাড়ে পড়ে ওঁকে জড়িয়ে রয়েছে। এই আগুনই তো চাই, এই প্ৰত্যক্ষ আগুন । মক্ষ্মীরানী, আমার এই একটি অনুরোধ রাখবেন, আর-একদিন তেমনি অগ্নিশিখা সেজে আমাদের দেখা দেবেন। t এতদিন আমি ছিলুম গ্রামের একটি ছোটাে নদী- তখন ছিল আমার এক ছন্দ, এক ভাষা- কিন্তু কখন একদিন কোনো খবর না দিয়ে সমুদ্রের বান ডেকে গেল— আমার বুক ফুলে উঠল, আমার কুল ছাপিয়ে গেল, সমুদ্রের ডমরুর তালে তালে আমার স্রোতের কলতান আপনি বেজে বেজে উঠতে লাগল; আমি আপনার রক্তের ভিতরকার সেই ধ্বনির ঠিক অর্থটা তো কিছুই বুঝতে পারলুম না। সে আমি কোথায় গেল ? হঠাৎ আমার মধ্যে রূপের ঢেউ কোথা থেকে এমন করে ফেনিয়ে এল ? সদীপবাবুর দুই অতৃপ্ত চােখ আমার সৌন্দর্যের দিকে যেন পূজার প্রদীপের মতো জ্বলে উঠল। রূপেতে শক্তিতে আমি যে আশ্চর্য সে কথা সন্দীপবাবুর সমস্ত চাওয়ায় কওয়ায় মন্দিরের সুপ্রিল মতো আকাশ ঘটায় বাঙ্গতে লাগল। সেদিন তাতেই পৃথিবীর অন্য সমস্ত আওয়ায় ঢেকে দিলে । . আমাকে কি বিধাতা আজ একেবারে নতুন করে সৃষ্টি করলেন ? তার এতদিনকার অনাদরের শোধ দিয়ে দিলেন ? যে সুন্দরী ছিল না। সে সুন্দরী হয়ে উঠল। যে ছিল সামান্য সে নিজের মধ্যে সমস্ত বাংলাদেশের গৌরবকে প্রত্যক্ষ অনুভব করলে। সদীপবাবু তো কেবল একটিমাত্র মানুষ নন, তিনি যে একলাই দেশের লক্ষ লক্ষ চিত্তধারার মোহনার মতো । তাই, তিনি যখন আমাকে বললেন, মাউচকের মক্ষ্মীরানী, তখন সেদিনকার সমস্ত দেশসেবকদের স্তবগুঞ্জনধ্বনিতে আমার অভিষেক হয়ে গেল। এর পরে আমাদের ঘরের কোণে আমার বড়ো জায়ের নিঃশব্দ অবজ্ঞা আর আমার মেজো জায়ের সশব্দ পরিহাস আমাকে স্পর্শ করতেই পারলে না । সমস্ত জগতের সঙ্গে আমার সম্বন্ধের পরিবর্তন হয়ে গেছে । r সদীপবাবু আমাকে বুঝিয়ে দিলেন, আমাকে যেন সমস্ত দেশের ভারি দরকার। সেদিন সে কথা আমার বিশ্বাস করতে বাধে নি। আমি পারি, সমস্তই পারি, আমার মধ্যে একটা দিব্যশক্তি এসেছে ; সে এমন-একটা কিছু যাকে ইতিপূর্বে আমি অনুভব করি নি, যা আমার অতীত। আমার অন্তরের মধ্যে এই-যে একটা বিপুল আবেগ হঠাৎ এল এ জিনিসটা কী, সে নিয়ে আমার মনে কোনো দ্বিধা ওঠবার সময় ছিল না ; এ যেন আমারই, অথচ এ যেন আমার নয় ; এ যেন আমার বাইরেকর, এ যেন সমস্ত দেশের। এ যেন বানের জল, এর জন্যে কোনো খিড়কির পুকুরের জবাবদিহি নেই। সংকোচ বোধ হত, কিন্তু সেটা অল্প দিনেই কেটে গেল। আমি যা বলতুম তাতেই সন্দীপবাবু আশ্চর্য হয়ে যেতেন। তিনি কেবলই বলতেন, আমরা পুরুষরা কেবলমাত্ৰ ভাবতেই পারি, কিন্তু আপনারা বুঝতে পারেন, আপনাদের আর ভাবতে হয় না। মেয়েদেরই বিধাতা মানস থেকে সৃষ্টি করেছেন, আর