পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী ܠ O?) করে নিয়ে পড়ছে, পায়ের শব্দ পেয়েই তাড়াতাড়ি সেটার উপর আর-একটা বই চাপা দিয়ে উঠে পড়ল । যে বইটা চাপা দিল সেটা লংফেলোর কবিতা । আমি বললুম, দেখুন। আপনারা কবিতার বই পড়তে লজ্জা পান কেন আমি কিছুই বুঝতে পারি নে। লজ্জা পাবার কথা পুরুষের ; কেননা, আমরা কেউ বা অ্যাটনি, কেউ বা এঞ্জিনিয়ার। আমাদের যদি কবিতা পড়তেই হয় তা হলে অর্ধেকরাত্রে দরজা বন্ধ করে পড়া উচিত। কবিতার সঙ্গেই তো আপনাদের আগাগোড়া মিল। যে বিধাতা আপনাদের সৃষ্টি করেছেন তিনি যে গীতিকবি, জয়দেব তারই পায়ের কাছে বসে "ললিতলবঙ্গলতা'য় হাত পাকিয়েছেন । মক্ষীরানী কোনাে জবাব না দিয়ে হেসে লাল হয়ে চলে যাবার উদযোগ করতেই আমি বললুম, না, সে হবে না, আপনি বসে বসে পড়ুন। আমি একখানা বই ফেলে গিয়েছিলুম, সেটা নিয়েই দৌড় ਜਿਇ | আমার বইখানা টেবিল থেকে তুলে নিলুম। বললুম, ভাগো এ বই আপনার হাতে পড়ে নি, তা হলে আপনি হয়তো আমাকে মারতে আসতেন । মক্ষী বললেন, কেন ? আমি বললুম, কেননা এ কবিতার বই নয়। এতে যা আছে সে একেবারে মানুষের মোটা কথা, খুব মোটা করেই বলা, কোনোরকম চাতুরী নেই। আমার খুব ইচ্ছে ছিল এ বইটা নিখিল পড়ে। একটুখানি ভুকুঞ্চিত করে মক্ষী বললে, কেন বলুন দেখি । আমি বললুম, ও যে পুরুষমানুষ, আমাদেরই দলের লোক। এই স্থূল জগৎটাকে ও কেবলই ঝাপসা করে দেখতে চায়, সেইজন্যেই ওর সঙ্গে আমার ঝগড়া বাধে । আপনি তো দেখছেন সেইজন্যেই আমাদের স্বদেশী ব্যাপারটাকে ও লংফেলোর কবিতার মতো ঠাউরেছে— যেন ফি কথায় মধুর ছন্দ বঁচিয়ে চলতে হবে এইরকম ওর মতলব ! আমরা গদ্যের গদা নিয়ে বেড়াই, আমরা ছন্দ ভাঙার দল | মক্ষী বললে, স্বদেশীর সঙ্গে এ বইটার যোগ কী ? আমি বললুম, আপনি পড়ে দেখলেই বুঝতে পারবেন । কী স্বদেশ কী অন্য সব বিষয়েই নিখিল বানানো কথা নিয়ে চলতে চায়, তাই পদে পদে মানুষের যেটা স্বভাব তারই সঙ্গে ওর ঠোকাঠুকি বাধে, তখন ও স্বভাবকে গাল দিতে থাকে ; কিছুতেই এ কথাটা ও মানতে চায় না যে, কথা তৈরি হবার বহু আগেই আমাদের স্বভাব তৈরি হয়ে গেছে, কথা থেমে যাবার বহু পরেও আমাদের স্বভাব বেঁচে থাকবে । মক্ষী খানিকক্ষণ চুপ করে রইল ; তার পরে গভীরভাবে বললে, স্বভাবের চেয়ে বড়ো হতে চাওয়াটাই কি আমাদের স্বভাব নয় ? আমি মনে মনে হাসলুম— ওগো ও রানী, এ তোমার আপনি বুলি নয়, এ নিখিলেশের কাছে শেখা ৷ তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ প্রকৃতিস্থ মানুষ, স্বভাবের রসে দিব্যি টস টস করছি ; যেমনি স্বভাবের ডাক শুনেছ। আমনি তোমার সমস্ত রক্তমাংস সাড়া দিতে শুরু করেছে- এতদিন এরা তোমার কানে যে মন্ত্র দিয়েছে সেই মায়ামন্ত্রজালে তোমাকে ধরে রাখতে পারবে কেন ? তুমি যে জীবনের আগুনের তেজে শিরায় শিরায় জুলছ আমি কি জানি নে ? তোমাকে সাধুকথার ভিজে গামছা জড়িয়ে ঠাণ্ডা রাখবে। আর কতদিন ? আমি বললুম, পৃথিবীতে দুর্বল লোকের সংখ্যাই বেশি ; তারা নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্যে ওই রকমের মন্ত্র দিন রাত পৃথিবীর কানে আউড়ে আউড়ে সবল লোকের কান খারাপ করে দিচ্ছে। স্বভাব যাদের বঞ্চিত ক’রে কাহিল ক’রে রেখেছে তারাই অন্যের স্বভাবকে কহিল করবার পরামর্শ দেয় । মন্ধী বললে, আমরা মেয়েরাও তো দুর্বল, দুর্বলের ষড়যন্ত্রে আমাদেরও তো যোগ দিতে হবে। আমি হেসে বললুম, কে বললে দুর্বল ? পুরুষমানুষ তোমাদের অবলা বলে স্তুতিবাদ করে করে তোমাদের লজ্জা দিয়ে দুর্বল করে রেখেছে। আমার বিশ্বাস তোমরাই সবল। তোমরা পুরুষের মস্ত্ৰে-গড়া দুর্গ ভেঙে ফেলে ভয়ংকরী হয়ে মুক্তি লাভ করবে, এ আমি লিখে-পড়ে দিচ্ছি। বাইরেই