পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে বাইরে (ሱo© পুরুষরা হাঁকড়াক করে বেড়ায়, কিন্তু তাদের ভিতরটা তো দেখছ- তারা অত্যন্ত বদ্ধ জীব। আজ পর্যন্ত তারাই তো নিজের হাতে শাস্ত্ৰ গড়ে নিজেকে বেঁধেছে, নিজের ফুয়ে এবং আগুনে মেয়েজাতকে সোনার শিকল বানিয়ে অন্তরে বাইরে আপনাকে জড়িয়েছে। এমনি করে নিজের ফঁাদে নিজেকে বঁধবার অদ্ভূত ক্ষমতা যদি পুরুষের না থাকত তা হলে পুরুষকে আজ ধরে রাখত কে ? নিজের তৈরি ফাঁদই পুরুষের সব চেয়ে বড়ো উপাস্য দেবতা। তাকেই পুরুষ নানা রঙে রাঙিয়েছে, নানা সাজে সাজিয়েছে, নানা নামে পুজো দিয়েছে। কিন্তু মেয়েরা ? তোমরাই দেহ দিয়ে মন দিয়ে পৃথিবীতে রক্তমাংসের বাস্তবকে চেয়েছ, বাস্তবকে জন্ম দিয়েছ, বাস্তবকে পালন করেছ। মন্ধী শিক্ষিত মেয়ে, সহজে তর্ক করতে ছাড়ে না ; সে বললে, তাই যদি সত্যি হত তা হলে পুরুষ কি মেয়েকে পছন্দ করতে পারত ? আমি বললুম, মেয়েরা সেই বিপদের কথা জানে ; তারা জানে পুরুষজাতটা স্বভাবত ফাকি । ভালোবাসে। সেইজন্যে তারা পুরুষের কাছ থেকেই কথা ধার করে ফাকি সেজে পুরুষকে ভোলাবার চেষ্টা করে। তারা জানে খাদ্যের চেয়ে মদের দিকেই স্বভাবমাতাল পুরুষজাতটার ঝোক বেশি, এইজন্যেই নানা কৌশলে নানা ভাবে ভঙ্গিতে তারা নিজেকে মদ বলেই চালাতে চায় ; আসলে তারা যে খাদ্য সেটা যথাসাধ্য গোপন করে রাখে । মেয়েরা বস্তুতন্ত্র, তাদের কোনো মোহের উপকরণের দরকার করে না ; পুরুষের জন্যেই তো যত রকম-বেরকম মোহের আয়োজন। মেয়েরা মোহিনী হয়েছে নেহাত দায়ে পড়ে । মক্ষী বললে, তবে এ মোহ ভাঙতে চান কেন ? আমি বললুম, স্বাধীনতা চাই বলে। দেশেও স্বাধীনতা চাই, মানুষের সঙ্গে সম্বন্ধেও স্বাধীনতা চাই । দেশ আমার কাছে অত্যন্ত বাস্তব, সেইজন্যে আমি কোনো নীতিকথার ধোওয়ায় তাকে এতটুকু আড়াল করে দেখতে পারব না ; আমি আমার কাছে অত্যন্ত বাস্তব, তুমি আমার কাছে অত্যন্ত বাস্তব, সেইজন্যে মাঝখানে কেবল কতকগুলো কথা ছড়িয়ে মানুষের কাছে মানুষকে দুৰ্গম দুর্বোধ করে তোেলবার ব্যবসায় আমি একটুও পছন্দ করি নে। আমার মনে ছিল যে লোক ঘুমোতে ঘুমোতে চলছে তাকে হঠাৎ চমকিয়ে দেওয়া কিছু নয়। কিন্তু আমার স্বভাবটা যে দুৰ্দাম, ধীরে সুস্থে চলা আমার চাল নয়। জানি যে কথা সেদিন বললুম তার ভঙ্গিটা তার সুরাটা বড়ো সাহসিক ; জানি এরকম কথার প্রথম আঘাত কিছু দুঃসহ ; কিন্তু মেয়েদের । কাছে সাহসিকেরই জয় । পুরুষরা ভালোবাসে ধোওয়াকে, আর মেয়েরা ভালোবাসে বস্তুকে, সেইজন্যেই পুরুষ পুজো করতে ছােটে তার নিজের আইডিয়ার অবতারকে, আর মেয়েরা তাদের সমস্ত অর্ঘ্য এনে হাজির করে প্রবলের পায়ের তলায় । 翰 আমাদের কথাটা ঠিক যখন গরম হয়ে উঠতে চলেছে এমন সময় আমাদের ঘরের মধ্যে নিখিলের ছেলেবেলাকার মাস্টার চন্দ্রনাথবাবু এসে উপস্থিত। মোটের উপরে পৃথিবী জায়গাটা বেশ ভালোই । ছিল, কিন্তু এই সব মাস্টারমশায়দের উৎপাতে। এখান থেকে বাস ওঠাতে ইচ্ছে করে। নিখিলেশের মতো মানুষ মৃত্যুকাল পর্যন্ত এই সংসারটাকে ইস্কুল বানিয়ে রেখে দিতে চায়। বয়স হল, তবু ইস্কুল পিছন-পিছন চলল ; সংসারে প্রবেশ করলে, সেখানেও ইস্কুল এসে ঢুকল। উচিত, মরবার সময়ে ইস্কুলমাস্টারটিকে সহমরণে টেনে নিয়ে যাওয়া। সেদিন আমাদের আলাপের মাঝখানে অসময়ে সেই মূর্তিমান ইস্কুল এসে হাজির। আমাদের সকলেরই ধাতের মধ্যে এক জায়গায় একটা ছাত্র বাসা করে আছে বোধ করি। আমি যে এ-হেন দুৰ্বত্ত, আমিও কেমন থমকে গেলুম। আর আমাদের মন্ধী, তার মুখ দেখেই মনে হল সে এক মুহুর্তেই ক্লাসের সব চেয়ে ভালো ছাত্রী হয়ে একেবারে প্রথম সারে গভীর হয়ে বসে গেল ; তার হঠাৎ যেন মনে পড়ে গেল পৃথিবীতে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার একটা দায় আছে। এক-একটা মানুষ রেলের পয়েণ্টসম্যানের মতো পথের ধারে বসে থাকে, তারা ভাবনার গাড়িকে খামক এক লাইন থেকে আর-এক লাইনে চালান করে দেয় ।