পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

હ૦૭ রবীন্দ্ররচনাবলী এই কথা বলেই সে ঘরের থেকে বেরিয়ে চলে গেল। আমি অবাক হয়ে তার এই কাণ্ড দেখছি, এমন সময় হঠাৎ একটা শব্দ শুনে দেখি টেবিলের উপর থেকে দুটাে-তিনটে বই মেঝের উপর পড়ল আর মন্ধীরানী ত্ৰস্তপদে আমার থেকে যেন একটু দূর দিয়ে চলে গেল। 曾 অদ্ভুত মানুষ ঐ নিখিলেশ ৷৷ ও বেশ বুঝেছে। ওর ঘরের মধ্যে একটা বিপদ ঘনিয়ে এসেছে, কিন্তু তবু আমাকে ঘাড় ধরে বিদেয় করে দেয় না কেন ? আমি জানি, ও অপেক্ষা করে আছে বিমল কী করে। বিমল যদি ওকে বলে “তোমার সঙ্গে আমার জোড় মেলেনি। তবেই ও মাথা হেঁট করে মৃদুস্বরে বলবে, তা হলে দেখছি ভুল হয়ে গেছে। ভুলকে ভুল বলে মানলেই সব চেয়ে বড়ো ভুল করা হয়, এ কথা বোঝবার জোর ওর নেই। আইডিয়ায় মানুষকে যে কত কাহিল করে তার প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত হল নিখিল । ও-রকম পুরুষমানুষ আর দ্বিতীয় দেখিনি ; ও নিতান্তই প্রকৃতির একটা খেয়াল। ওকে নিয়ে একটা ভদ্র রকমের গল্প কি নাটক গড়াও চলে না, ঘর করা তো দূরের কথা। তার পরে মন্ধী, বেশ বোধ হচ্ছে আজকে ওর ঘোর ভেঙে গেছে। ও যে কোন স্রোতে ভেসেছে হঠাৎ আজ সেটা বুঝতে পেরেছে। এখন ওকে জেনেশুনে হয় ফিরতে হবে নয় এগোতে হবে। তা নয়, এখন থেকে ও একবার এগোবে, একবার পিছবে। তাতে আমার ভাবনা নেই। কাপড়ে যখন আগুন লাগে তখন ভয়ে যতই ছুটােছুটি করে আগুন ততই বেশি করে জ্বলে ওঠে । ভয়ের ধাক্কাতেই ওর হৃদয়ের বেগ আরো বেশি করে বেড়ে উঠবে। আরো তো এমন দেখেছি। সেই তো বিধবা কুসুম ভয়েতে কঁাপিতে কঁাপিতেই আমার কাছে এসে ধরা দিয়েছিল । আর, আমাদের হস্টেলের কাছে যে ফিরিঙ্গি মেয়ে ছিল সে আমার উপরে রাগ করলে এক-একদিন মনে হত সে আমাকে রেগে যেন ছিড়ে ফেলে দেবে। সেদিনকার কথা আমার বেশ মনে আছে যেদিন সে চীৎকার করে যাও যাও’ বলে আমাকে ঘর থেকে জোর করে তাড়িয়ে দিলে, তার পরে যেমনি আমি চৌকাঠের বাইরে পা বাড়িয়েছি অমনি সে ছুটে এসে আমার পা জড়িয়ে ধরে কঁদিতে কঁদিতে মেঝেতে মাথা ঠুকতে ঠুকতে মূৰ্ছিত হয়ে পড়ল। ওদের আমি খুব জানি- রাগ বলো, ভয় বলো, লজ্জা বলো, ঘৃণা বলে, এ-সমস্তই জ্বালানি কাঠের মতো। ওদের হৃদয়ের আগুনকে বাড়িয়ে তুলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। যে জিনিস এ আগুনকে সামলাতে পারে সে হচ্ছে আইডিয়ােল। মেয়েদের সে বালাই নেই। ওরা পুণ্য করে, তীৰ্থ করে, গুরুঠাকুরের পায়ের কাছে গড় হয়ে পড়ে প্ৰণাম করে- আমরা যেমন করে আপিস করি— কিন্তু আইডিয়ার ধার দিয়ে যায় না। : আমি নিজের মুখে ওকে বেশি কিছু বলব না, এখনকার কালের কতকগুলো ইংরেজি বই ওকে পড়তে দেব। ও ক্ৰমে ক্ৰমে বেশ স্পষ্ট করে বুঝতে পারুক যে, প্রবৃত্তিকে বাস্তব বলে স্বীকার করা ও শ্রদ্ধা করাই হচ্ছে মডােরন। প্রবৃত্তিকে লজ্জা করা, সংযমকে বড়ো জানাটা মডারন নয়। মডারন এই কথাটার যদি আশ্রয় পায় তা হলেই ও জোর পাবে ; কেননা ওদের তীর্থ চাই, গুরুঠাকুর চাই, বাধা সংস্কার চাই, শুধু আইডিয়া ওদের কাছে ফাকা । যাই হােক, এ নাট্যটা পঞ্চম অঙ্ক পর্যন্ত দেখা যাক । এ কথা জাক করে বলতে পারব না। আমি কেবলমাত্র দর্শক, উপরের তলায় রয়াল সীটে বসে মাঝে মাঝে কেবল হাততালি দিচ্ছি। বুকের ভিতরে টান পড়ছে, থেকে থেকে শিরাগুলো ব্যথিয়ে উঠছে। রাত্রে বাতি নিবিয়ে বিছানায় যখন শুই তখন এতটুকু ছোওয়া, এতটুকু চাওয়া, এতটুকু কথা অন্ধকার ভর্তি করে কেবলই ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে মনের ভিতরটায় একটা পুলক ঝিলমিল করতে থাকে, মনে হয় যেন রক্তের সঙ্গে সঙ্গে সর্বাঙ্গে একটা সুরের ধারা বইছে! : এই টেবিলের উপরকার ফোটাে-স্ট্যান্ডে নিখিলের ছবির পাশে মক্ষ্মীর ছবি ছিল । আমি সে ছবিটি খুলে নিয়েছিলুম। কাল মন্ধীকে সেই ফাকটা দেখিয়ে বললুম, কৃপণের কৃপণতার দোষেই চুরি হয়, অতএব এই চুরির পােপটা কৃপণে চোরে ভাগাভাগি করে নেওয়াই উচিত। কী বলেন ? মন্ধী একটু হাসলে ; বললে, ও ছবিটা তো তেমন ভালো ছিল না।