পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Qのbr রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী সামাজিক স্ত্রী যেখানে থাকে থাক, আমি বিদায় হলুম। দুঃখ তো আছেই। কিন্তু একটা দুঃখ বড়ো মিথো হবে, সেটা থেকে নিজেকে যে করে পারি বঁাচাবই। কাপুরুষের মতো এ কথা মনে করতে পারব না যে, অনাদরে আমার জীবনের দাম কমে গেল। আমার জীবনের মূল্য আছে ; সেই মূল্য দিয়ে আমি কেবল আমার ঘরের অন্তঃপুরটুকু কিনে রাখবার জন্যে আসি নি। আমার যা বড়ো ব্যাবসা সে কিছুতেই দেউলে হবে না, আজ এই কথাটা খুব সত্য করে ভাববার দিন এসেছে । আজ যেমন নিজেকে তেমনি বিমলকেও সম্পূর্ণ বাইরে থেকে দেখতে হবে। এতদিন আমি আমারই মনের কতকগুলি দামি আইডিয়ােল দিয়ে বিমলকে সাজিয়েছিলুম। আমার সেই মানসী মূর্তির সঙ্গে সংসারে বিমলের সব জায়গায় যে মিল ছিল তা নয়, কিন্তু তবুও আমি তাকে পূজা করে এসেছি আমার মানসীর মধ্যে । সেটা আমার গুণ নয়, সেইটেই আমার মহদোষ । আমি লোভী ; আমি আমার সেই মানসী। তিলোত্তমাকে মনে মনে ভোগ করতে চেয়েছিলুম, বাইরের বিমল তার উপলক্ষ হয়ে পড়েছিল। বিমল যা সে তাইই ; তাকে যে আমার খাতিরে তিলোত্তম হতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। বিশ্বকর্ম আমারই ফর্মাস খাটছেন না কি ? তা হলে আজ একবার আমাকে সমস্ত পরিষ্কার করে দেখে নিতে হবে ; মায়ার রঙে যে-সব চিত্ৰবিচিত্র করেছি। সে আজ খুব শক্ত করে মুছে ফেলব। এতদিন অনেক জিনিস আমি দেখেও দেখি নি। আজ এ কথা স্পষ্ট বুঝেছি, বিমলের জীবনে আমি আকস্মিক মাত্র ; বিমলের সমস্ত প্রকৃতি যার সঙ্গে সত্য মিলতে পারে সে হচ্ছে সন্দীপ । এইটুকু জানাই আমার পক্ষে যথেষ্ট । কেননা, আজ আমার নিজের কাছেও নিজের বিনয় করবার দিন নেই | সন্দীপের মধ্যে অনেক গুণ আছে যা লোভনীয়, সেই গুণে আমাকেও এতদিন সে আকর্ষণ করে এসেছে, কিন্তু খুব কম করেও যদি বলি তবু এ কথা আজ নিজের কাছে বলতে হবে যে, মোটের উপর সে আমার চেয়ে বড়ো নয় । স্বয়ম্বরসভায় আজ আমার গলায় যদি মালা না পড়ে, যদি মালা সন্দীপই পায়, তবে এই উপেক্ষায় দেবতা তারই বিচার করলেন যিনি মালা দিলেন, আমার নয় । আজ আমার এ কথা অহংকার করে বলা নয় । আজ নিজের মূল্যকে নিজের মধ্যে যদি একান্ত সত্য করে না জানি ও না। স্বীকার করি, আজকেকার এই আঘাতকে যদি আমার এই মানবজন্মের চরম অপমান বলেই মেনে নিতে হয়, তা হলে আমি আবর্জনার মতো সংসারের আঁস্তাকুড়ে গিয়ে পড়ব ; আমার দ্বারা আর কোনো কাজই হবে ୩ | অতএব আজ সমস্ত অসহ্য দুঃখের ভিতর দিয়েও আমার মনের মধ্যে একটা মুক্তির আনন্দ জাগুক ! চেনাশোনা হল ; বাহিরকেও বুঝলুম, অন্তরকেও বুঝলুম । সমস্ত লাভ-লোকসান মিটিয়ে যা বাকি রইল। তাই আমি । সে তো পঙ্গু-আমি নয়, দরিদ্র-আমি নয়, সে অন্তঃপুরের রোগীর-পথ্যে-মানুষ-করা রোগা আমি নয় ; সে বিধাতার শক্ত-হাতের তৈরি। আমি । যা তার হবার তা হয়ে গেছে, আর তার কিছুতে মার নেই। এইমাত্র মাস্টারমশায় আমার কাছে এসে আমার কাধে হাত রেখে আমাকে বললেন, নিখিল, শুতে যাও, রাত একটা হয়ে গেছে | অনেক রাত্রে বিমল খুব গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে না পড়লে আমার পক্ষে শুতে যাওয়া ভারি কঠিন হয় । দিনের বেলা তার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয়, কথাবার্তাও চলে, কিন্তু বিছানার মধ্যে একলা-রাতের নিস্তব্ধতায় তার সঙ্গে কী কথা বলব ? আমার সমস্ত দেহমান লজ্জিত হয়ে ওঠে । আমি মাস্টারমশায়কে জিজ্ঞাসা করলুম, আপনি এখনো ঘুমোন নি কেন ? তিনি একটু হেসে বললেন, আমার এখন ঘুমোবার বয়স গেছে, এখন জেগে থাকবার বয়স । এই পর্যন্ত লেখা হয়ে শুতে যাব যাব করছি এমন সময়ে আমার জানলার সামনের আকাশে