পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে Gło শ্রাবণের মেঘ হঠাৎ একটা জায়গায় ছিন্ন হয়ে গেল, আর তারই মধ্যে থেকে একটি বড়ো তারা জ্বল জ্বল করে উঠল। আমার মনে হল আমাকে সে বললে, কত সম্বন্ধ ভাঙছে গড়ছে স্বপ্নের মতো, কিন্তু । আমি ঠিক আছি, আমি বাসরঘরের চিরপ্রদীপের শিখা, আমি মিলনরাত্রির চিরাচুম্বন। সেই মুহুর্তে আমার সমস্ত বুক ভরে উঠে। মনে হল, এই বিশ্ববস্তুর পর্দার আড়ালে আমার অনন্তকালের প্ৰেয়সী স্থির হয়ে বসে আছে। কত জন্মে কত আয়নায় ক্ষণে ক্ষণে তার ছবি দেখলুমকত ভাঙা আয়না, বঁকা আয়না, ধূলোয়-অস্পষ্ট আয়না। যখনই বলি। ‘আয়নাটা আমারই করে নিই ‘বাক্সর ভিতরে করে রাখি। তখনই ছবি সরে যায়। থােক-না, আমার আয়নাতেই বা কী, আর ছবিতেই বা কী ! প্ৰেয়সী, তোমার বিশ্বাস অটুট রইল, তোমার হাসি স্নান হবে না, তুমি আমার জন্যে সীমান্তে যে সিঁদুরের রেখা ঐকেছ প্রতিদিনের অরুণোদয় তাকে উজ্জ্বল করে ফুটিয়ে রাখছে। একটা শয়তান অন্ধকারের কোণে দাঁড়িয়ে বলছে, এ-সব তোমার ছেলে-ভোলানাে কথা ! তা হােক-না, ছেলেকে তো ভোলাতেই হবে- লক্ষ ছেলে, কোটি ছেলে, ছেলের পর ছেলে- কত ছেলের কত কান্না ! এত ছেলেকে কি মিথ্যে দিয়ে ভোলানো চলে ? আমার প্ৰেয়সী আমাকে ঠকাবে না— সে সত্য, সে সত্য- এইজন্যে বারে বারে তাকে দেখলুম, বারে বারে তাকে দেখব ; ভুলের ভিতর দিয়েও তাকে দেখেছি, চােখের জলের ঘন কুয়াশার মধ্য দিয়েও তাকে দেখা গেল। জীবনের হাটের ভিড়ের মধ্যে তাকে দেখেছি, হারিয়েছি, আবার দেখেছি, মরণের ফুকোরের ভিতর দিয়ে বেরিয়ে গিয়েও তাকে দেখব । ওগো নিষ্ঠুর, আর পরিহাস কোরো না। যে পথে তোমার পায়ের চিহ্ন পড়েছে, যে বাতাসে তোমার এলো চুলের গন্ধ ভরে আছে, এবার যদি তার ঠিকানা ভুল করে থাকি তবে সেই ভুলে আমাকে চিরদিন কঁাদিয়ে না। ঐ ঘোমটা-খোলা তারা আমাকে বলছে, না, না, ভয় নেই, যা চিরদিন থাকবার তা চিরদিনই আছে । এইবার দেখে আসি আমার বিমলকে, সে বিছানায় এলিয়ে পড়ে ঘুমিয়ে আছে। তাকে না জাগিয়ে তার ললাটে একটি চুম্বন রেখে দিই। সেই চুম্বন আমার পূজার নৈবেদ্য। আমার বিশ্বাস, মৃত্যুর পরে আর সবই ভুলব- সব ভুল, সব কান্না, কিন্তু এই চুম্বনের স্মৃতির স্পন্দন কোনো একটা জায়গায় থেকে যাবে- কেননা, জন্মের পর জন্মে এই চুম্বনের মালা যে গাঁথা হয়ে যাচ্ছে সেই প্রেয়সীর গলায় পরানো হবে বলে । এমন সময়ে আমার ঘরের মধ্যে আমার মেজো ভাজ এসে ঢুকলেন। তখন আমাদের পাহারার ঘড়িতে ঢং ঢেং করে দুটাে বাজল । ፶ ঠাকুরপো, তুমি করছ কী ? লক্ষ্মী ভাই, শুতে যাও- তুমি নিজেকে এমন করে দুঃখ দিয়ে না। তোমার চেহারা যা হয়ে গেছে সে আমি চোখে দেখতে পারি। নে । এই বলতে বলতে র্তার চােখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়তে লাগল। আমি একটি কথাও না বলে তাকে প্ৰণাম করে তার পায়ের ধুলো নিয়ে শুতে গেলুম। : বিমলার আত্মকথা । গোড়ায় কিছুই সন্দেহ করি নি, ভয় করি নি ; আমি জানতুম দেশের কাছে আত্মসমৰ্পণ করছি। পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণে কী প্রচণ্ড উল্লাস! নিজের সর্বনাশ করাই নিজের সব চেয়ে আনন্দ এই কথা সেদিন প্রথম আবিষ্কার করেছিলুম। জানি নে, হয়তো এমনি করেই একটা অস্পষ্ট আবেগের ভিতর দিয়ে এই নেশােটা একদিন আপনিই কেটে যেত। কিন্তু সন্দীপবাবু যে থাকতে পারলেন না, তিনি যে নিজেকে স্পষ্ট করে তুললেন । তার কথার সুর যেন স্পর্শ হয়ে আমাকে খুঁয়ে যায়, চােখের চাহনি যেন ভিক্ষা হয়ে আমার পায়ে ধরে । ।