পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে tyరి দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে মুখ তুলে সন্দীপ আমাকে দেখে যেন চমকে উঠলেন। বললেন, এই যে আপনি এসেছেন ! কথাটার মধ্যে, কথার সুরে, তীর দুই চােখে, একটা চাপা ভৎসনা। আমার এমন দশা যে, এই ভৎসনাকেও মেনে নিলুম। আমার উপর সন্দীপের যে দাবি জন্মেছে তাতে আমার দু-তিন দিনের অনুপস্থিতিও যেন অপরাধ। সন্দীপের এই অভিমান যে আমার প্রতি অপমান সে আমি জানি, কিন্তু রাগ করবার শক্তি কই ! কোনো জবাব না দিয়ে চুপ করে রইলুম। যদিও আমি অন্য দিকে চেয়ে ছিলুম। তবু বেশ বুঝতে পারছিলুম সন্দীপের দুই চক্ষের নালিশ আমার মুখের সামনে যেন। ধন্ন দিয়ে পড়েই ছিল, সে আর নড়তে চাচ্ছিল না। এ কী কাণ্ড ! সন্দীপ কোনো-একটা কথা তুললে সেই কথার আড়ালে একটু লুকিয়ে বঁচি যে। বোধ হয়। পঁাচ মিনিট কি দশ মিনিট যখন এমনি করে লজ্জা অসহ্য হয়ে এল তখন আমি বললুম, আপনি কী দরকারে আমাকে ডেকেছিলেন ? সদীপ ঈষৎ চমকে উঠে বললেন, কেন, দরকার কি থাকতেই হবে ? বন্ধুত্ব কি অপরাধ ? পৃথিবীতে যা সব চেয়ে বড়ো তার এতই অনাদর ? হৃদয়ের পূজাকে কি পথের কুকুরের মতাে দরজার বাইরে থেকে খেদিয়ে দিতে হবে মক্ষীরানী ? আমার বুকের মধ্যে দূরদূর করতে লাগল। বিপদ ক্রমশই কাছে ঘনিয়ে আসছে, আর তাকে ঠেকিয়ে রাখা যায় না। আমার মনের মধ্যে পুলক আর ভয় দুইই সমান হয়ে উঠল। এই সর্বনাশের বোঝা আমি আমার পিঠ দিয়ে সামলাব কী করে ? আমাকে যে পথের ধুলোর উপর মুখ থুবড়ে পড়তে হবে! আমার হাত পা কঁপিছিল। আমি খুব শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে তঁাকে বললুম, সন্দীপবাবু, আপনি দেশের কী কাজ আছে বলে আমাকে ডেকেছেন, তাই আমার ঘরের কাজ ফেলে এসেছি। তিনি একটু হেসে বললেন, আমি তো সেই কথাই আপনাকে বলছিলুম। আমি যে পূজার জন্যেই এসেছি তা জানেন ? আপনার মধ্যে আমি আমার দেশের শক্তিকেই প্রত্যক্ষ দেখতে পাই সে কথা কি আপনাকে বলি নি ? ভূগোলবিবরণ তো একটা সত্য বস্তু নয় ; শুধু সেই ম্যািপটার কথা স্মরণ করে কি কেউ জীবন দিতে পারে ? যখন আপনাকে সামনে দেখতে পাই তখনই তাে বুঝতে পারি, দেশ। কত সুন্দর, কত প্রিয়, প্ৰাণে তেজে কত পরিপূর্ণ ! আপনি নিজের হাতে আমার কপালে জয়টিকা পরিয়ে দেবেন, তবেই তো জানব আমি আমার দেশের আদেশ পেয়েছি ; তবেই তো সেই কথা স্মরণ করে লড়তে লড়তে মৃত্যুবাণ খেয়ে যদি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি তবে বুঝব, সে কেবলমাত্র ভূগোলবিবরণের মাটি নয়, সে একখানা আঁচল— কেমন আঁচল জানেন ? আপনি সেদিন যে একখানি শাড়ি পরেছিলেন, লাল মাটির মতো তার রঙ, আর তার চওড়া পাড় একটি রক্তের ধারার মতো রাঙা, সেই শাড়ির আঁচল ! সে কি আমি কোনোদিন ভুলতে পারব ! এই-সব জিনিসই তো জীবনকে সতেজ, মৃত্যুকে রমণীয় করে তোলে। বলতে বলতে সন্দীপের দুই চোখ জ্বলে উঠল। চােখে সে ক্ষুধার আগুন কি পূজার সে আমি । বুঝতে পারলুম না। আমার সেই দিনের কথা মনে পড়ল। যেদিন আমি প্রথম ওঁর বক্তৃতা শুনেছিলুম। সেদিন, তিনি অগ্নিশিখা না মানুষ সে আমি ভুলে গিয়েছিলুম। সাধারণ মানুষের সঙ্গে মানুষের মতাে ব্যবহার করা চলে— তার অনেক কায়দা-কানুন আছে। কিন্তু আগুন যে আর-এক জাতের ; সে এক নিমেষে চোখে ধাধা লাগিয়ে দেয়, প্ৰলয়কে সুন্দর করে তোলে। মনে হতে থাকে, যে সত্য প্রতিদিনের শুকনো কাঠে হেলাফেলার মধ্যে লুকিয়ে ছিল সে আজ। আপনার দীপ্যমান মূর্তি ধরে চারি দিকের সমস্ত কৃপণের সঞ্চয়গুলোকে অট্টহাস্যে দগ্ধ করতে ছুটে চলেছে। এর পরে আমার কিছু বলবার শক্তি ছিল না। আমার ভয় হতে লাগল এখনই সন্দীপ ছুটে এসে আমার হাত চেপে ধরবেন। কেননা তার হাত চঞ্চল আগুনের শিখার মতােই কঁপিছিল, আর তার চােখের দৃষ্টি আমার উপর যেন আগুনের স্মৃলিঙ্গের মতো এসে পড়ছিল। 8|\9N)