পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে (፩ S(፩ চালচলন কিছুতেই ভালো ঠেকে না- সেইজন্যে ভালো মনে করেই আমি দরোয়ানকে- তা এতে যে ছোটােরানীর অপমান হবে এ কথা মনেও করি নি, বরঞ্চ ভেবেছিলুম উল্টো । হায় রে পোড়া কপাল, আমার যেমন বুদ্ধি ! এমনি করে দেশের দিক থেকে, পূজার দিক থেকে, যে কথাটাকে এত উজ্জ্বল করে দেখি সেইটেই যখন নীচের দিক থেকে এমন করে ঘুলিয়ে উঠতে থাকে তখন প্রথমটা হয় রাগ, তার পরেই মনে গ্লানি उा6न । আজ শোবার ঘরে গিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে জানলার কাছে বসে বসে ভাবতে লাগলুম, চার দিকের সঙ্গে সুর মিলিয়ে জীবনটা আসলে কতই সরল হতে পারে। ঐ-যে মেজোরানী নিশ্চিন্তমনে বারান্দায় বসে সুপুরি কাটছেন, ঐ সহজ আসনে বসে। সহজ কাজের ধারা আমার কাছে আজ আমন দুৰ্গম হয়ে উঠল! রোজ রোজ নিজেকে জিজ্ঞাসা করি, এর শেষ কোনখানে ? আমি কি মরে যাব, সন্দীপ কি চলে যাবে, এ-সমস্তই কি রোগীর প্রলাপের মতো সুস্থ হয়ে উঠে একেবারে ভুলে যাব- না ঘাড়মোড় ভেঙে এমন সর্বনাশের তলায় তলিয়ে যাব যেখান থেকে ইহজীবনে আমার আর উদ্ধার নেই ? জীবনের সৌভাগ্যকে সরলভাবে গ্রহণ করতে পারলুম না, এমন করে ছারখার করে দিলুম কী করে । আমার এই শোবার ঘর, যে ঘরে আজান বৎসর আগে নতুন বউ হয়ে পা দিয়েছিলুম, সেই ঘরের সমস্ত দেয়াল ছাদ মেজে আমার মুখের দিকে চেয়ে আজ অবাক হয়ে আছে। এম. এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আমার স্বামী কলকাতা থেকে ভারতসাগরের কোন এক দ্বীপের অনেক দামী এই পরগাছাটি কিনে এনেছিলেন। এই কটি মাত্র পাতা, কিন্তু তাতে লম্বা যে একটি ফুলের গুচ্ছ ফুটেছিল সে যেন সৌন্দর্যের কোন পেয়ালা একেবারে উপুড় করে ঢেলে দেওয়া, ইন্দ্ৰধনু যেন ঐকটি পাতার কোলে ফুল হয়ে জন্ম নিয়ে দােল খাচ্ছে। সেই ফুটন্ত পরগাছাটিকে আমরা দুজনে মিলে আমাদের শেবার ঘরের এই জানলার কাছে টাঙিয়ে রেখেছি। সেই একবার ফুল হয়েছিল, আর হয় নি, আশা আছে আবার আর-একদিন ফুল ফুটবে। আশ্চর্য এই যে, অভ্যাসমত আজও এই গাছে আমি রোজ জল দিচ্ছি, আশ্চর্য এই যে, সেই নারকেল,দড়ি দিয়ে পাকে পাকে আঁট করে বাধা এই পাতা-কয়টির বাধন আলগা হল না- তার পাতাগুলি আজও সবুজ আছে। আজ চার বছর হল আমার স্বামীর একটি ছবি হাতির দাতের ফ্রেমে বঁধিয়ে ঐ কুলুঙ্গির মধ্যে রেখে দিয়েছিলুম। ওর দিকে দৈবাৎ যখন আমার চােখ পড়ে আর চােখ তুলতে পারি নে। আজ ছ-দিন আগেও রোজ সকালে স্নানের পর ফুল তুলে ঐ ছবির সামনে রেখে প্ৰণাম করেছি। কত দিন এই নিয়ে স্বামীর সঙ্গে আমার তর্ক হয়ে গেছে। একদিন তিনি বললেন, তুমি যে আমাকে আমার চেয়ে বড়ো করে তুলে পুজো কর, এতে আমার বড়ো লজ্জা বোধ হয় । আমি জিজ্ঞাসা করলুম, কেন তোমার লজ্জা ? স্বামী বললেন, শুধু লজ্জা নয়, ঈর্ষা। আমি বললুম, শোনাে একবার কথা। তোমার আবার ঈর্ষা কাকে ? স্বামী বললেন, ঐ মিথ্যে-আমিটাকে । এর থেকে বুঝতে পারি। এই সামান্য আমাকে নিয়ে তোমার সন্তোষ নেই, তুমি এমন অসামান্য কাউকে চাও যে তােমার বুদ্ধিকে অভিভূত করে দেবে; তাই আর-একটা আমাকে তুমি মন দিয়ে গড়ে তোমার মন ভোলােচ্ছ। আমি বললুম, তোমার এই কথাগুলো শুনলে আমার রাগ হয়। তিনি বললেন, রাগ আমার উপরে করে কী হবে, তোমার অদৃষ্ট্রের উপর করো। তুমি তো আমাকে স্বয়ম্বর সভায় বেছে নাও নি, যেমনটি পেয়েছ তেমনি তোমাকে চােখ বুজে নিতে হয়েছে; কাজেই দেবত্ব দিয়ে আমাকে যতটা পাের সংশোধন করে নিচ্ছ। দময়ন্তী স্বয়ম্বরা হয়েছিলেন বলেই দেবতাকে বাদ দিয়ে মানুষকে নিতে পেরেছিলেন, তােমরা স্বয়ম্বর হতে পারনি বলেই রোজ মানুষকে বাদ দিয়ে