পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

《》° রবীন্দ্র-রচনাবলী (लदठान्न १ोलाश भाला श्।ि সেদিন এই কথাটা নিয়ে এত রাগ করেছিলুম যে আমার চােখ দিয়ে জল পড়ে গিয়েছিল। তাই মনে করে আজ ঐ কুলুঙ্গিটার দিকে চােখ তুলতে পারি নে। ] ঐ-যে আমার গয়নার বাক্সের মধ্যে আর-এক ছবি আছে। সেদিন বাইরের বৈঠকখানাঘর ঝাড়পোছ করবার উপলক্ষে সেই ফোটােস্ট্যান্ডখন তুলে এনেছি, সেই যার মধ্যে আমার স্বামীর ছবির পাশে সন্দীপের ছবি আছে। সে ছবি তো পূজো করি নে, তাকে প্ৰণাম করা চলে না ; সে রইল আমার হীরে-মানিক-মুক্তের মধ্যে ঢাকা, সে লুকোনাে রইল বলেই তার মধ্যে এত পুলক। ঘরে সব দরজা বন্ধ করে তবে তাকে খুলে দেখি । রাত্রে আস্তে আস্তে কেরোসিনের বাতিটা উসকে তুলে তার সামনে ঐ ছবিটা ধরে চুপ করে চেয়ে বসে থাকি। তার পরে রোজই মনে করি এই কেরোসিনের শিখায় ওকে আমার হীরে-মানিক-মুক্তোর নীচে তাকে চাপা দিয়ে চাবি বন্ধ করে রাখি। কিন্তু, পোড়ারমুখী, এই হীরে-মানিক-মুক্তো তোকে দিয়েছিল কে ? এর মধ্যে কত দিনের কত আদর জড়িয়ে আছে। তারা আজ কোথায় মুখ লুকোবে ? মরণ হলে যে বীচি।। সদীপ একদিন আমাকে বলেছিলেন, দ্বিধা করাটা মেয়েদের প্রকৃতি নয়। তার ডাইনে বীয়ে নেই, তার একমাত্র আছে সামনে। তিনি বারবার বলেন, দেশের মেয়েরা যখন জগবে তখন তারা পুরুষের চেয়ে ঢের বেশি স্পষ্ট করে বলবে “আমরা চাই— সেই চাওয়ার কাছে কোনাে ভালো-মন্দ কোনাে সম্ভব-অসম্ভবের তর্কবিতর্ক টিকতে পারবে না । তাদের কেবল এক কথা “আমরা চাই । “আমি চাই । এই বাণীই হচ্ছে সৃষ্টির মূল বাণী ; সেই বাণীই কোনাে শাস্ত্ৰবিচার না করে আগুন হয়ে সূর্যে তারায় জ্বলে উঠেছে। ভয়ংকর তার প্রণয়ের পক্ষপাত ; মানুষকে সে কামনা করেছে বলেই যুগযুগান্তরের লক্ষ লক্ষ প্রাণীকে তার সেই কামনার কাছে বলি দিতে দিতে এসেছে। সৃজন-প্রলয়ের সেই ভয়ংকরী ‘আমি চাই বাণী আজ মেয়েদের মধ্যেই মূর্তিমতী। সেইজন্যেই ভীরু পুরুষ সৃজনের সেই আদিম বন্যাকে বাধা দিয়ে ঠেকিয়ে রাখবার চেষ্টা করছে, পাছে সে তাদের কুমড়ে খেতের মাচাগুলোকে অট্টকলহাস্যে ভাসিয়ে নিয়ে নাচতে নাচতে চলে যায় । পুরুষ মনে করে আছে, এই বাধকে সে চিরকালের মতো পাকা করে বেঁধে রেখেছে। জমছে, জল জমছে- হ্রদের জলরাশি আজ শান্ত গভীর ; আজ সে চলেও না, আজ সে বলেও না ; পুরুষের রান্নাঘরের জলের জালা নিঃশব্দে ভর্তি করে। কিন্তু চাপ আর সইবে না, বঁধ ভাঙবে ; তখন এতদিনের বোবা শক্তি ‘আমি চাই “আমি চাই বলে গর্জন করতে করতে ছুটবে। সন্দীপের এই কথা আমার মনের মধ্যে যেন ডমরু বাজাতে থাকে। তাই আমার আপনার সঙ্গে যখন আপনার বিরোধ বাধে, যখন লজ্জা আমাকে ধিককার দিতে থাকে, তখন সন্দীপের কথা আমার মনে আসে। তখন বুঝতে পারি। আমার এ লজ্জা কেবল লোকলজ্জা, সে আমার মেজো জায়ের মূর্তি ধরে বাইরে বসে বসে সুপুরি কাটতে কাটতে কটাক্ষপাত করছে। তাকে আমি কিসের গ্রাহ্য করি! “আমি চাই এই কথাটাকেই নিঃসংকোচে অবাধে অন্তরে বাহিরে সমস্ত শক্তি দিয়ে বলতে পারাই হচ্ছে আপনার পূর্ণ প্রকাশ, না বলতে পারাই হচ্ছে ব্যর্থতা। কিসের ঐ পরগাছা, কিসের ঐ কুলুঙ্গি— আমার এই উদ্দীপ্ত আমিকে ব্যঙ্গ করে, অপমান করে, এমন সাধ্য ওদের কী আছে! এই বলে তখনই ইচ্ছে হল, ঐ পরগাছাটাকে জানলার বাইরে ফেলে দিই, ছবিটাকে কুলুঙ্গি থেকে নামিয়ে আনি, প্ৰলয়শক্তির লজ্জাহীন উলঙ্গতা প্রকাশ হােক। হাত উঠেছিল, কিন্তু বুকের মধ্যে বিধল, চােখে জল এল- মেজের উপরে উপুড় হয়ে পড়ে কঁদিতে লাগলুম। কী হবে, আমার কী হবে! আমার কপালে কী আছে!