পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

GS br রবীন্দ্র-রচনাবলী তাকে চেপেচুপে ঢেকেঢুকে রাখতে চাই, নইলে সমস্তটাকে সে মাটি করে দেয়। প্ৰাণ-জিনিসটা অস্পষ্ট, সে যে কত বিরুদ্ধতার সমষ্টি তার ঠিক নেই। আমরা আইডিয়াওয়ালা মানুষ তাকে একটা বিশেষ ছাচে ঢেলে একটা কোনো বিশেষ আকারে সুস্পষ্ট করে জানতে চাই ; সেই জীবনের সুস্পষ্টতই জীবনের সফলতা। দিগবিজয়ী সেকেন্দর থেকে শুরু করে আজকের দিনের আমেরিকার ক্রোড়পতি রকফেলার পর্যন্ত সকলেই নিজেকে তলোয়ারে কিংবা টাকার বিশেষ একটা ছাচে ঢেলে জমিয়ে দেখতে পেরেছে বলেই নিজেকে সফল করে জেনেছে। এইখনেই আমাদের নিখিলের সঙ্গে আমার তর্ক বাধে। আমিও বলি আপনাকে জানাে, সেও বলে আপনাকে জানো । কিন্তু সে যা বলে তাতে দাঁড়ায় এই আপনাকে না-জানাটাই হচ্ছে জানা । সে বলে, তুমি যাকে ফল পাওয়া বল সে হচ্ছে আপনাকে বাদ দিয়ে ফলটুকুকে পাওয়া। ফলের চেয়ে আত্মা আমি বললুম, কথাটা নেহাত ঝাপসা হল। নিখিল বললে, উপায় নেই। প্ৰাণটা কলের চেয়ে অস্পষ্ট, তাই বলে প্ৰাণটাকে কল বলে করে জানলেই যে প্ৰাণটাকে জানা হয় তা নয় । তেমনি আত্মা ফলের চেয়ে অস্পষ্ট, তাই আত্মাকে ফলের মধ্যে চরম করে দেখাই যে আত্মাকে সত্য দেখা তা বলব না । আমি জিজ্ঞাসা করলুম, তবে তুমি কোথায় আত্মাকে দেখছ ? কোন নাকের ডগায়, কোন ভুর २८ ? সে বললে, আত্মা যেখানে আপনাকে অসীম জানছে, যেখানে ফলকে ছেড়ে এবং ছড়িয়ে চলে যাচ্ছে । তা হলে নিজের দেশ সম্বন্ধে কী বলবে ? ঐ একই কথা। দেশ যেখানে বলে “আমি আমাকেই লক্ষ্য করব সেখানে সে ফল পেতে পারে, কিন্তু আত্মাকে হারায় ; যেখানে সকলের চেয়ে বড়োকে সকলের বড়ো করে দেখে সেখানে সকল ফলকেই সে খোওয়াতে পারে, কিন্তু আপনাকে সে পায় । ইতিহাসে এর দৃষ্টান্ত কোথায় দেখেছ ? মানুষ এত বড়ো যে সে যেমন ফলকে অবজ্ঞা করতে পারে তেমনি দৃষ্টান্তকেও । দৃষ্টান্ত হয়তো নেই, বীজের ভিতরে ফুলের দৃষ্টান্ত যেমন নেই ; কিন্তু বীজের ভিতরে ফুলের বেদনা আছে। তবু, দৃষ্টান্ত কি একেবারেই নেই ? বুদ্ধ বহু শতাব্দী ধরে যে সাধনায় সমস্ত ভারতবর্ষকে জাগিয়ে রেখেছিলেন সে কি ফলের সাধনা ? নিখিলের কথা আমি যে একেবারেই বুঝতে পারি। নে তা নয়। কিন্তু সেইটিই হল আমার মুশকিল। ভারতবর্ষে আমার জন্ম ; সাত্ত্বিকতার বিষ রক্তের মধ্যে থেকে একেবারে মরতে চায় না । আপনাকে বঞ্চিত করার পথে চলা যে পাগলামি এ কথা মুখে যতই বলি এটাকে একেবারে উড়িয়ে দেবার সাধ্য নেই। এইজন্যেই আমাদের দেশে আজকাল অদ্ভুত ব্যাপার চলছে। ধর্মের ধুয়াে দেশের ধুয়ো দুটিকেই পুরোদমে একসঙ্গে চালাচ্ছি- ভগবদগীতা এবং বন্দেমাতরং আমাদের দুইই চাই— তাতে দুটাের কোনোটাই যে স্পষ্ট হতে পারছে না, তাতে একসঙ্গেই গড়ের বাদ্য এবং সানাই বাজানে চলছে, এ আমরা বুঝছি নে। আমার জীবনের কাজ হচ্ছে এই বেসুরো গোলমালটাকে থামানো ; আমি গড়ের বাদ্যটাকেই বাহাল রাখব, সানাই আমাদের সর্বনাশ করেছে। প্রবৃত্তির যে জয়পতাকা আমাদের হাতে দিয়ে মা প্রকৃতি, মা শক্তি, মা মহামায় রণক্ষেত্রে আমাদের পাঠিয়েছেন তাকে আমরা লজ্জা দে না। প্রবৃত্তিই সুন্দর, প্রবৃত্তিই নির্মল, যেমন নির্মল ভুঁইচাপা ফুল, যে কথায় কথায় স্নানের ঘরে ভিনেলিয়া সাবান মাখতে ছোটে না । একটা প্রশ্ন কদিন ধরে মাথায় ঘুরছে, কেন বিমলের সঙ্গে জীবনটাকে জড়িয়ে ফেলতে দিচ্ছি। আমার জীবনটা তো ভেসে-যাওয়া কলার ভেলা নয় যে যেখানে-সেখানে ঠেকতে ঠেকতে চলবে সেই কথাই তো বলছিলুম যে একটিমাত্র আইডিয়ার ছাচে জীবনটাকে পরিমিত করতে চাই, জীব