পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

¢रे० রবীন্দ্র-রচনাবলী যাবে- সেই পরম অনিশ্চিতের গুহার সামনে দাঁড়িয়ে তার মুখ ফ্যাকাশে, তার দুই চক্ষে ভয় অথচ উদ্দীপনার দীপ্তি, এই সময়টুকুর মধ্যে একটা-কিছু স্থির হয়ে যাবে তারই জন্যে সমস্ত আকাশ-পাতাল নিশ্বাস রোধ করে যেন থমকে দাঁড়িয়ে । কিন্তু সেই মুহুর্তগুলিকে বয়ে যেতে দিয়েছি ; নিঃসংকোচ বলের সঙ্গে নিশ্চিতপ্রায়কে এক নিমেষে নিশ্চিত হয়ে উঠতে দিই নি। এর থেকে বুঝতে পারছি এতদিন যে-সব বাধা আমার প্রকৃতির মধ্যে লুকিয়ে ছিল তারা আজ আমার রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়েছে। যে রাবণকে আমি রামায়ণের প্রধান নায়ক বলে শ্রদ্ধা করি সেও এমনি করেই মরেছিল। সীতাকে আপনার অন্তঃপুরে না। এনে সে অশোকবনে রেখেছিল । অত বড়ো বীরের অন্তরের মধ্যে ঐ এক জায়গায় একটু যে কাচা সংকোচ ছিল তারই জন্যে সমস্ত লঙ্কাকাণ্ডটা একেবারে ব্যর্থ হয়ে গেল। এই সংকোচটুিকু না থাকলে সীতা আপন সতী নাম ঘুচিয়ে রাবণকে পুজো করত । এইরকমেরই একটু সংকোচ ছিল বলেই যে বিভীষণকে তার মারা উচিত ছিল তাকে রাবণ চিরদিন দয়া এবং অবজ্ঞা করলে, আর মোলো নিজে । জীবনের ট্রাজেডি এইখনেই । সে ছোটাে হয়ে হৃদয়ের এক তলায় লুকিয়ে থাকে, তার পরে বড়োকে এক মুহুর্তে কত করে দেয়। মানুষ আপনাকে যা বলে জানে মানুষ তা নয়, সেইজন্যেই এত उकाव्यंन्म श0 | নিখিল যে এমন অদ্ভুত, তাকে দেখে যে এত হাসি, তবু ভিতরে ভিতরে এও কিছুতে অস্বীকার করতে পারি। নে যে সে আমার বন্ধু। প্রথমটা তার কথা বেশি কিছু ভাবি নি ; কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে তার কাছে লজ্জা পাচ্ছি, কষ্টও বোধ হচ্ছে। এক-একদিন আগেকার মতো তার সঙ্গে খুব করে গল্প করতে তর্ক করতে যাই, কিন্তু উৎসাহটা কেমন অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে— এমন-কি, যা কখনো করি নে তাও করি, তার মতের সঙ্গে মত মেলাবার ভান করে থাকি । কিন্তু এই কপটতা জিনিসটা আমার সয় না, এটা নিখিলেরও সয় না- এইখানে ওর সঙ্গে আমার মিল আছে | তাই জন্যে আজকাল নিখিলকে এড়িয়ে চলতে চাই, কোনোমতে দেখাটা না হলেই বাচি । এই-সব হচ্ছে দুর্বলতার লক্ষণ । অপরাধের ভূতটাকে মানবামাত্রই সে একটা সত্যকার জিনিস হয়ে দাঁড়ায় ; তখন তাকে যতই অবিশ্বাস করি।-না কেন, সে চেপে ধরে । আমি নিখিলের কাছে এইটেই অসংকোচে জানাতে চাই, এ-সব জিনিসকে বড়ো করে বাস্তব করে দেখতে হবে । যা সত্য তার মধ্যে প্রকৃত বন্ধুত্বের কোনো ব্যাঘাত থাকা উচিত নয়। কিন্তু এ কথাটা আর অস্বীকার করতে পারছি নে এইবার আমাকে দুর্বল করেছে । আমার এই দুর্বলতায় বিমল মুগ্ধ হয় নি ; আমার অসংকোচ পৌরুষের আগুনেই সেই পাতঙ্গিনী তার পাখা পুড়িয়েছে। আবেশের ধোওয়ায় যখন আমাকে আচ্ছন্ন করে তখন বিমলার মনও আবিষ্ট হয়, কিন্তু তখন ওর মনে ঘূণা জন্মে ; তখন আমার গলা থেকে ওর স্বয়ম্বরের মালা ফিরিয়ে নিতে পারে না বটে, কিন্তু সেটা দেখে ও চোখ বুজতে চায় । কিন্তু ফেরবার পথ বন্ধ হয়ে গেছে, আমাদের দুজনেরই । বিমলাকে যে ছাড়তে পারব এমন শক্তি ও নিজের মধ্যে দেখছি নে ! তাই বলে নিজের পথটাও আমি ছাড়তে পারব না । আমার পথ লোকের ভিড়ের পথ ; এই অন্তঃপুরের খিড়কির দরজার পথ নয়। আমি আমার স্বদেশকে ছাড়তে পারব না, ঝড়ে আমার স্বদেশলক্ষ্মীর মুখের উপর থেকে ন্যায়-অন্যায়ের ঘোমটা উড়ে গেছে সেই ঝড়েই বিমলার মুখে বধূর ঘোমটা খুলবে— সেই অনবরণে তার অগীেরব থাকবে না । জনসমুদ্রের ঢেউয়ের উপর দুলবে তরী, উড়বে তাতে "বন্দেমাতরং জয়পতাকা, চারি দিকে গর্জন আর ফেনা— সেই নীেকেই একসঙ্গে আমাদের শক্তির দোলা আর প্রেমের দোলা । বিমলা সেখানে মুক্তির এমন একটা বিরাট রূপ দেখবে যে তার দিকে চেয়ে তার সকল বন্ধন বিনা লজ্জায় এক সময়ে নিজের অগোচরে ধসে যাবে । এই প্রলয়ের রূপে মুগ্ধ হয়ে নিষ্ঠুর হয়ে উঠতে ওর এক মুহূর্তের জন্যে বাধবে না। যে নিষ্ঠুরতাই প্রকৃতির সহজ শক্তি সেই পরমাসুন্দরী নিষ্ঠুরতার মূর্তি আমি বিমলার মধ্যে দেখেছি। মেয়েরা যদি ৷