পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে $ት ४२७ পুরুষের কৃত্রিম বন্ধন থেকে মুক্তি পেত তা হলে পৃথিবীতে কালীকে প্রত্যক্ষ দেখতে পেতুম- সেই দেবী নির্লজ, সে নির্দয় । আমি সেই কালীর উপাসক ; বিমলাকে সেই প্রলয়ের মাঝখানে টেনে নিয়ে আমি একদিন কালীর উপাসনা করব । এবার তারই আয়োজন করি । নিখিলেশের আত্মকথা ভদ্রের বন্যায় চারি দিক টলমল করছে ; কচি ধানের আভা যেন কচি ছেলের কঁচা দেহের লাবণ্য। আমাদের বাড়ির বাগানের নীচে পর্যন্ত জল এসেছে। সকালের রৌদ্রটি এই পৃথিবীর উপরে একেবারে অপর্যাপ্ত হয়ে পড়েছে, নীল আকাশের ভালোবাসার মতো । আমি কেন গান গাইতে পারি নে! খালের জল ঝিলমিল করছে, গাছের পাতা ঝিকমিক করছে, ধানের খেত ক্ষণে ক্ষণে শিউরে শিউরে চিকচিকিয়ে উঠছে- এই শরতের প্রভাতসংগীতে আমিই কেবল বোবা! আমার মধ্যে সুর অবরুদ্ধ ; আমার মধ্যে বিশ্বের সমস্ত উজ্জ্বলতা আটকা পড়ে যায়, ফিরে যেতে পায় না। আমার এই প্রকাশহীন দীপ্তিহীন আপনাকে যখন দেখতে পাই তখন বুঝতে পারি পৃথিবীতে কেন আমি বঞ্চিত। আমার সঙ্গ দিনরাত্রি কেউ সইতে পারবে কেন ! বিমল যে প্রাণের বেগে একেবারে ভরা। সেইজন্যে এই ন বছরের মধ্যে এক মুহূর্তের জন্যে সে আমার কাছে পুরোনো হয় নি। কিন্তু আমার মধ্যে যদি কিছু থাকে সে কেবল বোবা গভীরতা, সে তো কলধ্বনিত বেগ নয় । আমি কেবল গ্ৰহণ করতেই পারি, কিন্তু নাড়া দিতে পারি নে। আমার সঙ্গ মানুষের পক্ষে উপবাসের মতো ; বিমল এতদিন যে কী দুর্ভিক্ষের মধ্যেই ছিল তা আজকের ওকে দেখে বুঝতে পারছি। দোষ দেব কাকে ? : 曾 शश (5- ভরা বান্দর, মাহ ভাদর, - ! শূন্য মন্দির মোর گی আমার মন্দির যে শূন্য থাকবার জন্যেই তৈরি, ওর যে দরজা বন্ধ। আমার যে দেবতা ছিল সে মন্দিরের বাইরেই বসে ছিল, এতকাল তা বুঝতে পারিনি। মনে করেছিলুম অর্ঘ্য সে নিয়েছে, বরও সে দিয়েছে- কিন্তু শূন্য মন্দির মোর, শূন্য মন্দির মোর। প্রতি বৎসর ভাদ্রমাসে পৃথিবীর এই ভরা যৌবনে আমরা দুজনে শুক্লপক্ষে আমাদের শামলদহর বিলে বােটে করে বেড়াতে যৌতুম। কৃষ্ণপঞ্চমীতে যখন সন্ধ্যাবেলাকার জ্যোৎস্না ফুরিয়ে গিয়ে একেবারে তলায় এসে ঠেকত তখন আমরা বাড়ি ফিরে আসতুম। আমি বিমলকে বলতুম, গানকে বারে বারে আপনি ধুয়ােয় ফিরে আসতে হয় ; জীবনে মিলনসংগীতের ধুয়ােই হচ্ছে এইখানে, এই খোলা প্রকৃতির মধ্যে ; এই ছলছল করা জলের উপরে যেখানে 'বায়ু বহে পুরবৈয়া, যেখানে শ্যামল পৃথিবী মাথায় ছায়ার ঘোমটা টেনে নিস্তব্ধ জ্যোৎস্নায় কুলে কুলে কান পেতে সারারাত আড়ি পাতছে- সেইখানেই স্ত্রীপুরুষের প্রথম চার চক্ষের মিলন হয়েছিল, দেয়ালের মধ্যে নয়- তাই এখানে আমরা একবার করে সেই আদিযুগের প্রথম মিলনের ধুয়ের মধ্যে ফিরে আসি, যে মিলন হচ্ছে হরপার্বতীর মিলন, কৈলাসে মানস-সরোবরের পদ্মবনে। আমার বিবাহের পর দু বছর কলকাতায় পরীক্ষার হাঙ্গামে কেটেছে ; তার পরে আজ এই সাত বছর প্রতি ভাদ্রমাসের চাদ আমাদের সেই জলের বাসরঘরে বিকশিত কুমুদবনের ধারে তার নীরব শুভশঙ্খ বাজিয়ে এসেছে। জীবনের সেই এক সপ্তক এমনি করে কাটল। আজ দ্বিতীয় সপ্তক আরম্ভ হয়েছে। ভদ্রের সেই শুক্লপক্ষ এসেছে, সে কথা আমি তো কিছুতেই ভুলতে পারছি নে। প্রথম তিন দিন তো কেটে গেল ; বিমলের মনে পড়েছে কি না জানি নে, কিন্তু মনে করিয়ে দিল না। সব একেবারে