পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Q○o রবীন্দ্র-রচনাবলী আজ আমার কেবলই মনে হয়, পুরুষমানুষের একটা নেশা চাই, কিন্তু সে নেশা যেন মেয়েমানুষ না श् । আমাদের শুকসায়রের হাট এ জেলার মধ্যে মস্ত বড়ো হাট । এখানে জেলার এ ধারে নিত্য বাজার বসে, আর জেলার ও ধারে প্রতি শনিবারে হাট লাগে ; বর্ষার পর থেকেই এই হাট বেশি করে জমে । তখন নদীর সঙ্গে জেলার যোগ হয়ে যাতায়াতের পথ সহজ হয়ে যায়। তখন সুতো এবং আগামী শীতের জন্যে গরম কাপড়ের আমদানি খুব বেড়ে ওঠে । সেই সময়টাতে দিশি কাপড় আর দিশি নুন-চিনির বিরোধ নিয়ে বাংলাদেশের হাটে হাটে তুমুল গণ্ডগোল বেধেছে। আমাদের সকলেরই খুব একটা জেদ চড়ে গেছে । আমাকে সন্দীপ এসে বললেন, এত বড়ো হাটবাজার আমাদের হাতে আছে এটাকে আগাগোড়া স্বদেশী করে তুলতে হবে । এই এলাকা থেকে বিলিতি অলক্ষ্মীকে কুলোর হাওয়া দিয়ে বিদায় করা চাই । আমি কোমর বেঁধে বললুম, চাই বৈকি । সন্দীপ বললেন, এ নিয়ে নিখিলের সঙ্গে আমার অনেক কথা-কাটাকাটি হয়ে গেছে, কিছুতে পেরে উঠলুম না ; ও বলে, বক্তৃতা পর্যন্ত চলবে, কিন্তু জবৰ্দস্তি চলবে না । আমি একটু অহংকার করেই বললুম, আচ্ছ, সে আমি দেখছি । আমি জানি আমার উপর আমার স্বামীর ভালোবাসা কত গভীর । সেদিন আমার বুদ্ধি যদি স্থির থাকত তা হলে আমার পোড়া মুখ নিয়ে এমন দিনে সেই ভালোবাসার উপর দাবি করতে যেতে আমার লজ্জায় মাথা কাটা যেত। কিন্তু সন্দীপকে যে দেখাতে হবে আমার শক্তি কত ! তার কাছে আমি যে শক্তিরূপিণী ! তিনি তীর আশ্চর্য ব্যাখ্যার দ্বারা বার বার আমাকে এই কথাই বুঝিয়েছেন যে, পরমাশক্তি এক-একজন বিশেষ মানুষের কাছে এক-একজন বিশেষ মানুষেরই রূপে দেখা দেন ; তিনি বলেন, আমরা বৈষ্ণবতত্ত্বের হ্রাদিনীশক্তিকে প্রত্যক্ষ দেখবার জন্যেই এত ব্যাকুল হয়ে বেড়াচ্ছি, যখন কোথাও দেখতে পাই তখনই স্পষ্ট বুঝতে পারি। আমার অন্তরের মধ্যে যে ত্ৰিভঙ্গ বাঁশি বাজাচ্ছেন তার বাঁশির অর্থটা কী । বলতে বলতে এক-একদিন গান ধরতেন— যখন দেখা দাও নি। রাধা, তখন বেজেছিল বাঁশি । এখন চোখে চোখে চেয়ে সুর যে আমার গেল ভাসি । তখন নানা তানের ছলে এখন আমার সকল কাদা রাধার রূপে উঠল। হাসি । এই-সব কেবলই শুনতে শুনতে আমি ভুলে গিয়েছিলুম যে, আমি বিমলা । আমি শক্তিতত্ত্ব, আমি রসতত্ত্ব, আমার কোনো বন্ধন নেই, আমার মধ্যে সমস্তই সম্ভব, আমি যা-কিছুকে স্পর্শ করছি তাকেই নূতন করে সৃষ্টি করছি— নূতন করে সৃষ্টি করেছি। আমার এই জগৎকে- আমার হৃদয়ের পরশমণি ছোয়াবার আগে শরতের আকাশে এত সোনা ছিল না । আর মুহূর্তে মুহূর্তে আমি নূতন করছি ঐ বীরকে, ঐ সাধককে— ঐ আমার ভক্তকে— ঐ জ্ঞানে উজ্জ্বল, তেজে উদ্দীপ্ত, ভাবের রসে অভিষিক্ত অপূর্ব প্রতিভাকে । আমি যে স্পষ্ট অনুভব করছি, ওর মধ্যে প্রতি ক্ষণে আমি নূতন প্রাণ ঢেলে দিচ্ছি, ও আমার নিজেরই সৃষ্টি । সেদিন অনেক অনুরোধ করে সন্দীপ তার একটি বিশেষ ভক্ত বালক অমূল্যচরণকে আমার কাছে এনেছিলেন । একদণ্ড পরেই আমি দেখতে পেলুম তার চোখের তারার মধ্যে একটা নূতন দীপ্তি জ্বলে উঠল, বুঝলুম সে আদ্যশক্তিকে দেখতে পেয়েছে, বুঝতে পারলুম ওর রক্তের মধ্যে আমারই সৃষ্টির কাজ আরম্ভ হয়েছে । পরদিন সন্দীপ আমাকে এসে বললেন, এ কী মন্ত্র তোমার, ও বালক তো আর সেই বালক নেই, ওর পলতেয় এক মুহুর্তে শিখ ধরে গেছে । তোমার এ আগুনকে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে রাখবে কে ? একে একে সবাই আসবে। একটি একটি করে প্রদীপ জুলতে জুলতে একদিন যে দেশে দেয়ালির উৎসব লাগবে । নিজের এই মহিমার নেশায় মাতাল হয়েই আমি মনে মনে ঠিক করেছিলুম, ভক্তকে আমি বরদান