পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৫৩২ ৷ রবীন্দ্র-রচনাবলী এ দিকে যে ব্যাবসাটুকু ধরে কোনােমতে তার দিন চলছিল তার সূত্র ছিন্ন হয়ে গেছে। প্রথম দিনকতক ঐ-যে মাস্টারমশায়ের ওখানে সে বাসা পেলে সেইটোকেই সে টেনে চলতে লাগল, তার নিজের বাড়িতে নড়বার নাম করতেও চায় না । শেষ কালে মাস্টারমশায় তাকে বললেন, পঞ্চ, তুমি বাড়িতে যাও, নইলে তোমার ঘর-দুয়ারগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। আমি তোমাকে কিছু টাকা ধার দিচ্ছি, তুমি কাপড়ের ব্যাবসা করে অল্প অল্প করে শোধ দিয়ে । প্রথমটা পঞ্চর মনে একটু খেদ হল ; মনে করলে দয়াধৰ্ম বলে একটা জিনিস জগতে নেই। তার পরে টাকাটা নেবার বেলায় মাস্টারমশায় যখন হ্যান্ডনেট লিখিয়ে নিলেন তখন ভাবলে, শোধ তো করতে হবে, এমন উপকারের মূল কী ! মাস্টারমশায় কাউকে বাইরের দিকে দান করে ভিতরের দিকে ঋণী করতে নিতান্ত নারাজ ; তিনি বলেন, মনের ইজ্জত চলে গেলে মানুষের জাত মারা যায়। হ্যান্ডনেটে টাকা নেওয়ার পর পঞ্চ মাস্টারমশায়কে খুব বড়ো করে প্রণাম করতে আর পারলে না, পায়ের ধূলোটা বাদ পড়ল। মাস্টারমশায় মনে মনে হাসলেন, তিনি প্ৰণামটা খাটাে করতে পারলেই বঁচেন । তিনি বলেন, আমি শ্রদ্ধা করব, আমাকে শ্রদ্ধা করবে, মানুষের সঙ্গে এই সম্বন্ধই আমার খাটি ; ভক্তি আমার পাওনার অতিরিক্ত | পঞ্চ কিছু ধুতি-শাড়ি কিছু শীতের কাপড় কিনে আনিয়ে চাষিদের ঘরে ঘরে বেচে বেড়াতে লািগল । নগদ দাম পেত না বটে, তেমনি কিছু-বা ধান, কিছু-বা পাট, কিছু-বা অন্য ফসল, যা হাতে হাতে আদায় করে আনত সেটা দামে কাটা যেত না । দু মাসের মধ্যেই সে মাস্টারমশায়ের এক কিস্তি সুদ এবং আসলের কিছু শোধ করে দিলে এবং এই ঋণশোধের অংশ প্ৰণামের থেকে কাটান পড়ল । পঞ্চ নিশ্চয় মনে করতে লাগল, মাস্টারমশায়কে সে যে একদিন গুরু বলে ঠাউরেছিল, ভুল করেছিল ; লোকটার কাঞ্চনের প্রতি দৃষ্টি আছে। এইরকমে পঞ্চর দিন চলে যাচ্ছিল। এমন সময়ে স্বদেশীর বান খুব প্রবল হয়ে এসে পড়ল । আমাদের এবং আশপাশের গ্রাম থেকে যে-সব ছেলে কলকাতার স্কুলে কলেজে পড়ত। তারা ছুটির সময় বাড়ি ফিরে এল, তাদের অনেকে স্কুল কলেজ ছেড়ে দিলে । তারা সবাই সন্দীপকে দলপতি করে স্বদেশী-প্রচারে মেতে উঠল। এদের অনেকেই আমার অবৈতনিক স্কুল থেকে এনট্রেন্স পাস করে গেছে, অনেককেই আমি কলকাতায় পড়বার বৃত্তি দিয়েছি। এরা একদিন দল বেঁধে আমার কাছে এসে উপস্থিত। বললে, আমাদের শুকসায়রের হাট থেকে বিলিতি সুতে র্যাপার প্রভৃতি একেবারে উঠিয়ে দিতে হবে । আমি বললুম, সে আমি পারব না। তারা বললে, কেন, আপনার লোকসান হবে ? বুঝলুম, কথাটা আমাকে একটু অপমান করে বলবার জন্যে । আমি বলতে যাচ্ছিলুম, আমার লোকসান নয়, গরিবের লোকসান । মাস্টারমশায় ছিলেন ; তিনি বলে উঠলেন, হী, ওঁর লোকসান বৈকি, সে লোকসান তো তোমাদের in তারা বললে, দেশের জন্যে মাস্টারমশায় তাদের কথা চাপা দিয়ে বললেন, দেশ বলতে মাটি তো নয়, এইসমস্ত মানুষই তো । তা, তোমরা কোনোদিন একবার চোখের কোণে এদের দিকে তাকিয়ে দেখেছ ? আর, আজ হঠাৎ মাঝখানে পড়ে এরা কী নুন খাবে আর কী কাপড় পরবে তাই নিয়ে অত্যাচার করতে এসেছ, এরা সইবে কেন, আর এদের সইতে দেব কেন ? তারা বললে, আমরা নিজেরাও তো দিশি নুন, দিশি চিনি, দিশি কাপড় ধরেছি। তিনি বললেন, তোমাদের মনে রাগ হয়েছে, জেদ হয়েছে, সেই নেশায় তোমরা যা করছি খুশি হয়ে করছি। তোমাদের পয়সা আছে, তোমরা দু পয়সা বেশি দিয়ে দিশি জিনিস কিনছ, তোমাদের সেই খুশিতে ওরা তো বাধা দিচ্ছে না। কিন্তু ওদের তোমরা যা করাতে চাচ্ছি সেটা কেবল জোরের উপরে |