পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে বাইরে Q○○ না গো, তোমরা খিচুড়ি পাকাবে কেন, তোমাদের টুটি চেপে ধরে খিচুড়ি গেলাবে। বঙ্গবিভাগ করবে, বলবে তোমাদের সুবিধের জন্যেই ; শিক্ষার দরজা। এঁটে বন্ধ করতে থাকবে, বলবে তোমাদেরই আদর্শ অত্যুচ্চ করে তোলবার সদভিপ্ৰায়ে ; তোমরা সাধু হয়ে অশ্রুপাত করতে থাকবে, আর আমরা অসাধু হয়ে মিথ্যের দুর্গ শক্ত করে বানাব। তোমাদের অশ্রু টিকবে না, কিন্তু আমাদের দুর্গ টিকবে। মাস্টারমশায় আমাকে বললেন, এ-সব তর্ক করবার কথা নয় নিখিল । আমাদের ভিতরেই এবং সকলের মূলেই যে একটি বিরাট সত্য আছে, এ কথা যে লোক নিজের ভিতর থেকেই উপলব্ধি না করতে পারে সে লোক কেমন করে বিশ্বাস করবে যে, সেই অন্তরতম সত্যকেই সমস্ত আবরণ মোচন করে প্রকাশ করাই মানুষের চরম লক্ষ্য, বাইরের জিনিসকে তৃপাকার করে তোলা লক্ষ্য নয় ? সন্দীপ হেসে উঠে বললে, আপনার এ কথা মাস্টারমশায়ের মতো কথাই হয়েছে। এ-সব কেবল বইয়ের পাতায় দেখা যায়, চােখের পাতায় দেখছি বাইরের জিনিসকে তৃপাকার করে তোলাই মানুষের চরম লক্ষ্য । আর সেই লক্ষ্যকে যারা বড়োরকম করে সাধন করছে তারা ব্যাবসার বিজ্ঞাপনে প্রতিদিন বড়ো অক্ষরে মিথ্যা কথা বলে, তারা রাষ্ট্রনীতির সদর-খাতায় খুব মোটা কলমে জাল হিসাব লেখে, তাদের খবরের কাগজ মিথ্যার বোঝাই জাহাজ, আর মাছি যেমন করে সন্নিপাতিক জ্বরের বীজ বহন করে তাদের ধর্মপ্রচারকেরা তেমনি করে মিথ্যাকে ছড়িয়ে ছড়িয়ে বেড়ায়। আমি তাদেরই শিষ্যআমি যখন কনগ্রেসের দলে ছিলুম। তখন আমি বাজার বুঝে আধ সেরা সত্যে সাড়ে-পনেরো সের জল মেশাতে কিছুমাত্র লজ্জা করি নি, আজ আমি সে দল থেকে বেরিয়ে এসেছি, আজও আমি এই ধর্মনীতিকেই সার জেনেছি যে, সত্য মানুষের লক্ষ্য নয়, লক্ষ্য হচ্ছে ফললাভ। সন্দীপ বললেন, হাঁ, সেই ফসল মিথ্যের আবাদে তবে ফলে। পায়ের নীচের মাটি একেবারে চিরে গুড়িয়ে ধুলো করে দিয়ে তবে সেই ফসল ফলে। আর যা সত্য, যা আপনি জন্মায়, সে হচ্ছে আগাছা, কঁাটগাছ ; তার থেকেই যারা ফলের আশা করে তারা কীটপতঙ্গের দল । এই বলেই সন্দীপ বেগে বেরিয়ে চলে গেল। মাস্টারমশায় একটু হেসে আমার দিকে চেয়ে বললেন, জান নিখিল ? সন্দীপ অধ্যমিক নয়, ও বিধাৰ্মিক ৷৷ ও অমাবস্যার চাঁদ ; চাঁদই বটে, কিন্তু ঘটনাক্রমে পূর্ণিমার উল্টো দিকে গিয়ে পড়েছে। لـ আমি বললুম, সেইজন্যে চিরদিনই ওর সঙ্গে আমার মতের মিল নেই, কিন্তু ওর প্রতি আমার স্বভাবের আকর্ষণ আছে। ও আমার অনেক ক্ষতি করেছে, আরো করবে, কিন্তু ওকে আমি অশ্রদ্ধা করতে পারি। নে । তিনি বললেন, সে আমি ক্ৰমে বুঝতে পারছি। আমি অনেক দিন আশ্চর্য হয়ে ভেবেছি, সন্দীপকে এতদিন তুমি কেমন করে সহ্য করে আছ। এমনকি, এক-একদিন আমার সন্দেহ হয়েছে এর মধ্যে তোমার দুর্বলতা আছে। এখন দেখতে পাচ্ছি, ওর সঙ্গে তোমার কথারই মিল নেই, কিন্তু ছন্দের মিল রয়েছে । । আমি কৌতুক করে বললুম, মিত্রে মিত্রে মিলে অমিত্ৰাক্ষর। হয়তো আমাদের ভাগ্যকবি প্যারাডাইস লস্ট এর মতো একটা এপিক লেখবার সংকল্প করেছেন। মাস্টারমশায় বললেন, এখন পাঞ্চকে নিয়ে কী করা যায় ? আমি বললুম, আপনি বলেছিলেন, যে বিঘেকয়েক জমির উপর পঞ্চর বাড়ি আছে সেটাতে অনেক দিন থেকে ওর মীেরসি স্বত্ব জন্মেছে, সেই স্বত্ব কাটিয়ে দেবার জনো ওর জমিদার অনেক চেষ্টা করছে। ওর সেই জমিটা আমি কিনে নিয়ে সেইখানেই ওকে আমার প্রজা করে রেখে দিই। আর এক-শো টাকার জরিমানা ? সে জরিমানার টাকা কিসের থেকে আদায় হবে ? জমি যে আমার হবে । আর ওর কাপড়ের বস্তা ? আমি আনিয়ে দিচ্ছি। আমার প্রজা হয়ে ও যেমন ইচ্ছে বিক্রি করুক, দেখি ওকে কে বাধা দেয়।