পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Q8の রবীন্দ্র-রচনাবলী भन्मCछ •ा | একটা চাষি তার ছেলেমেয়েদের জন্যে সস্তা দামের জর্মন শাল কিনে নিয়ে যাচ্ছিল, আমাদের দলের এখানকার গ্রামের একজন ছেলে তার সেই শাল-কটা কেড়ে নিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। তাই নিয়ে গোলমাল চলছে। আমরা তাকে বলছি, তোকে দিশি গরম কাপড় কিনে দিচ্ছি। কিন্তু সস্তা দামের দিশি গরম কাপড় কোথায় ? রঙিন কাপড় তো দেখি নে ৷ কাশ্মীরি শাল তো ওকে কিনে দিতে পারি নে। সে এসে নিখিলের কাছে কেঁদে পড়েছে। তিনি সেই ছেলেটার নামে নালিশ করবার হুকুম দিয়েছেন। নালিশের ঠিকমত তদবির যাতে না হয় আমলারা তার ভার নিয়েছে, এমন-কি, মোক্তার আমাদের দলে । এখন কথা হচ্ছে, যার কাপড় পোড়াবা তার জন্যে যদি দিশি কাপড় কিনে দিতে হয়, তার পরে আবার মামলা চলে, তা হলে তার টাকা পাই কোথায় ? আর, ঐ পুড়তে পুড়তে বিলিতি কাপড়ের ব্যাবসা যে গরম হয়ে উঠবে। নবাব যখন বেলোয়ারি ঝাড় ভাঙার শব্দে মুগ্ধ হয়ে ঘরে ঘরে ঝাড় ভেঙে বেড়ােত তখন ঝাড়ওয়ালার ব্যাবসার খুব উন্নতি হয়েছিল । দ্বিতীয় প্রশ্ন এই, সস্তা। অথচ দিশি গরম কাপড় বাজারে নেই। শীত এসে পড়েছে, এখন বিলিতি শাল-র্যাপার-মেরিনো রাখব কি তাড়াবা ? আমি বললুম, যে লোক বিলিতি কাপড় কিনবে তাকে দিশি কাপড় বখশিশ, দেওয়া চলবে না । দণ্ড তারই হওয়া চাই, আমাদের নয় । মামলা যারা করতে যাবে তাদের ফসলের খোলায় আগুন লাগিয়ে দেব, গায়ে হাত বুলিয়ে কিছু হবে না। ওহে অমূল্য, আমন চমকে উঠলে চলবে না । চাষির খোলায় আগুন দিয়ে রোশনাই করায় আমার শখ নেই । কিন্তু এ হল যুদ্ধ । দুঃখ দিতে যদি ডরাও তা হলে মধুর রসে ডুব মারো, রাধাভাবে ভোর হয়ে কী বলতেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে । আর বিলিতি গরম কাপড় ? যত অসুবিধেই হােক, ও কিছুতেই চলবে না । বিলিতির সঙ্গে কোনো কারণেই কোনোখানেই রফা করতে পারব না । বিলিতি রঙিন র্যাপার যখন ছিল না। তখন চাষির ছেলে মাথার উপর দিয়ে দোলাই জড়িয়ে শীত কাটাত, এখনো তাই করবে। তাতে তাদের শখ মিটবে না। তা জানি, কিন্তু শখ মেটাবার সময় এখন নয় । হাটে যারা নীেকো আনে তাদের মধ্যে অনেককে ছলে বলে বাধ্য করবার পথে কতকটা আনা গেছে। তাদের মধ্যে সব চেয়ে বড়ো হচ্ছে মিরজান, সে কিছুতেই নরম হল না । এখানকার নায়েব কুলদাকে জিজ্ঞাসা করা গেল, ওর ঐ নীেকোখানা ডুবিয়ে দিতে পার কি না । সে বললে, সে আর শক্ত কী, পারি ; কিন্তু দায় তো শেষকালে আমার ঘাড়ে পড়বে না ? আমি বললুম, দায়টাকে কারও ঘাড়ে পড়বার মতো আলগা জায়গায় রাখা উচিত নয়, তবু নিতান্তই যদি পড়ো-পড়ো হয় তো আমিই ঘাড় পেতে দেব । হাট হয়ে গেলে মিরজানের খালি নীেকো ঘাটে বাধা ছিল। মাঝিও ছিল না । নায়েব কৌশল করে একটা যাত্রার আসরে তাদের নিমন্ত্রণ করিয়েছিল । সেই রাত্রে নীেকোটাকে খুলে স্রোতের মাঝখানে নিয়ে গিয়ে তাকে ফুটাে করে তার মধ্যে রাবিশের বস্তা চাপিয়ে তাকে ডুবিয়ে দেওয়া হল। মিরজান সমস্তই বুঝলে। সে একেবারে আমার কাছে এসে কাঁদতে কাঁদতে হাত জোড় করে বললে, হজুর, গোস্তাকি হয়েছিল, এখন— আমি বললুম, এখন সেটা এমন স্পষ্ট করে বুঝতে পারলে কী করে ? তার জবাব না দিয়ে সে বললে, সে নীেকোখানার দাম দু হাজার টাকার কম হবে না হজুর । এখন আমার ইশ হয়েছে, এবারকার মতো কসুর যদি মাপ করেন বলে সে আমার পায়ে জড়িয়ে ধরল। তাকে বললুম। আর দিন-দশেক পরে আমার কাছে আসতে । এই লোকটাকে যদি এখন দু হাজার টাকা দেওয়া যায় তা হলে একে কিনে রাখতে পারি। এরই মতো মানুষকে দলে আনতে পারলে তবে কাজ হয়। কিছু বেশি করে টাকা জোগাড় করতে না পারলে কোনো ফল হবে না ।