পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে (84 এই তো হিপনটিজম। এই শক্তিই পৃথিবী জয় করবার শক্তি। কোনো উপায় নয়, উপকরণ নয়, এই সম্মোহন। কে বলে সত্যমেব জয়তে ? জয় হবে মোহের। বাঙালি সে কথা বুঝেছিল ; তাই বাঙালি এনেছিল দশভুজার পূজা, বাঙালি গড়েছিল সিংহবাহিনীর মূর্তি। সেই বাঙালি আবার আজ মূর্তি গড়বে, জয় করবে। বিশ্ব কেবল সম্মোহনে। বন্দেমাতরং ! আস্তে আস্তে হাতে ধরে বিমলাকে চৌকির উপরে উঠিয়ে বসালুম। এই উত্তেজনার পরে অবসাদ আসবার আগেই তাকে বললুম, বাংলাদেশে মায়ের পূজা প্রতিষ্ঠা করবার ভার তিনি আমার উপরেই দিয়েছেন, কিন্তু আমি যে গরিব । বিমলার মুখ তখনো লাল, চােখ তখনো বাম্পে ঢাকা ; সে গদগদ কণ্ঠে বললে, তুমি গরিব কিসের ? যার যা-কিছু আছে সব যে তোমারই। কিসের জন্যে বাক্স ভরে আমার গয়না জমে রয়েছে ? আমার সমস্ত সোনা-মানিক তোমার পুজোয় নাও-না কেড়ে, আমার কিছুই দরকার নেই। এর আগে আর-একবার বিমলা গয়না দিতে চেয়েছিল ; আমার কিছুতে বাধে না, ঐখানটায় বাধল। সংকোচটা কিসের আমি ভেবে দেখেছি। চিরদিন পুরুষই মেয়েকে গয়না দিয়ে সাজিয়ে । এসেছে, মেয়ের হাত থেকে গয়না নিতে গেলে কেমন যেন পৌরুষে ঘা পড়ে । কিন্তু এখানে নিজেকে ভোলা চাই। আমি নিচ্ছি নে। এ মায়ের পূজা, সমস্তই সেই পূজায় ঢািলব । এমন সমারোহ করে করতে হবে যে তেমন পূজা এ দেশে কেউ কোনোদিন দেখে নি। চিরদিনের মতো নূতন বাংলার ইতিহাসের মর্মের মাঝখানে এই পূজা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। এই পূজাই আমার ফুল শিল্পকারণে শেরে দেিয় যাব। বেতার সালে করে দেশে দুর্থ দেবতার সৃষ্ট করে 어 | এ তো গেল বড়ো কথা । কিন্তু ছোটাে কথাও যে পাড়তে হবে। আপাতত অন্তত তিন হাজার টাকা না হলে তো চলবেই না, পাচ হাজার হলেই বেশ সুডোল ভাবে চলে। কিন্তু এতবড়ো উদ্দীপনার মুখে হঠাৎ এই টাকার কথাটা কি বলা চলে ? কিন্তু আর সময় নেই। সংকোচের বুকে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে ফেললুম, রানী, এ দিকে যে ভাণ্ডার শূন্য হয়ে এল, কাজ दश श्श दएन । অমনি বিমলার মুখে একটা বেদনার কুঞ্চন দেখা দিল। আমি বুঝলুম, বিমলা ভাবছে, আমি এখনই বুঝি সেই পঞ্চাশ হাজার দাবি করছি। এই নিয়ে ওর বুকের উপর পাথর চেপে রয়েছে ; বোধ হয় সারারাত ভেবেছে, কিন্তু কোনো কিনারা পায় নি। প্রেমের পূজার আর কোনো উপচার তো হাতে নেই, হৃদয়কে তো স্পষ্ট করে আমার পায়ে ঢেলে দিতে পারছে না, সেইজন্যে। ওর মন চাচ্ছে এই মস্ত একটা টাকাকে ওর অবরুদ্ধ-আদরের প্রতিরূপ করে আমার কাছে এনে দিতে । কিন্তু কোনো রাস্তা না পেয়ে ওর প্রাণ হাঁপিয়ে উঠছে। ওর ঐ কষ্টটা আমার বুকে লাগছে। ও যে এখন সম্পূর্ণ আমারই ; উপড়ে তোলবার দুঃখ এখন তো আর দরকার নেই, এখন ওকে অনেক যত্নে বঁচিয়ে রাখতে হবে। আমি বললুম, রানী, এখন সেই পঞ্চাশ হাজারের বিশেষ দরকার নেই, হিসেব করে দেখছি হাজার, এমনকি, তিনি হাজার হলেও চলে যাবে। হঠাৎ টানটা কমে গিয়ে বিমলার হৃদয় একেবারে উচ্ছসিত হয়ে উঠল। সে যেন একটা গানের মতো বললে, পাচ হাজার তোমাকে এনে দেব | যে সুরে রাধিক গান গেয়েছিল বঁধুর লাগি কেশে আমি পরব। এমন ফুল স্বৰ্গে মর্তে তিন ভুবনে নাইকে যাহার মূল । বঁশির ধ্বনি হাওয়ায় ভাসে, সবার কানে বাজবে না সে- ত্ব দেখ লো চেয়ে, যমুনা ওই ছাপিয়ে গেল কুল। . এ ঠিক সেই সুরই, আর সেই গানই, আর সেই একই কথা- ‘পাঁচ হাজার তোমাকে এনে দেব” ।