পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে G8 পেয়েছে যে, পৈতৃক খেতাবের উপরেও স্বেপার্জিত খেতাব যোগ করে দেবার জন্যে আমার আয়োজন ব্যৰ্থ হবে না। লিখেছে, ‘স্বনাম পুরুষো ধন্য, কিন্তু দেশের লোক বিনামার ফর্মাশ দিয়াছে, সে খবরও আমরা রাখি।” আমার নামটা স্পষ্ট করে দেয় নি, কিন্তু বাইরের অস্পষ্টতার ভিতর থেকে সেটা খুব বড়ো করে ফুটে উঠেছে। এ দিকে মাতৃবৎসল হরিশ কুণ্ডুর গুণগান করে কাগজে চিঠির পর চিঠি বেরোচ্ছে। লিখেছে, মায়ের এমন সেবক দেশে যদি বেশি থাকত তা হলে এত দিনে ম্যাঞ্চেস্টারের কারখানা-ঘরের চিমনিগুলো পর্যন্ত বন্দেমাতরমের সুরে সমস্বরে রামশিঙে ফুকতে থাকত। এ দিকে আমার নামে লাল কালিতে লেখা একখানা চিঠি এসেছে, তাতে খবর দিয়েছে কোথায় কোথায় কোন কোন লিভারপুলের নিমকহালাল জমিদারের কাছারি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বলেছে, ভগবান পাবক এখন থেকে এই পাবনের কাজে লাগলেন ; মায়ের যারা সন্তান নয়। তারা যাতে মায়ের কোল জুড়ে থাকতে না পারে তার ব্যবস্থা হচ্ছে। নাম সই করেছে, ‘মায়ের কোলের অধম শরিক, শ্ৰীঅম্বিকাচরণ গুপ্ত।’ ] আমি জানি, এ সমস্তই আমার এখানকার সব ছাত্রদের রচনা। আমি ওদের দুই-একজনকে ডেকে সেই চিঠিখন দেখলুম। বি. এ. গভীর ভাবে বললে, আমরাও শুনেছি দেশে একদল লোক মরিয়া হয়ে রয়েছে, স্বদেশীর বাধা দূর করতে তারা না করতে পারে এমন কােজ নেই। আমি বললুম, তাদের অন্যায় জবৰ্দস্তিতে দেশের একজন লোকও যদি হার মানে তা হলে সেটাতে সমস্ত দেশের পরাভব । ইতিহাসে এম. এ. বললেন, বুঝতে পারছি নে। আমি বললুম, আমাদের দেশ দেবতাকে থেকে পেয়াদাকে পর্যন্ত ভয় করে করে আধমরা হয়ে রয়েছে, আজ তোমরা মুক্তির নাম করে সেই জুজুর ভয়কে ফের আর-এক নামে যদি দেশে চালাতে চাও, অত্যাচারের দ্বারা কাপুরুষতাটার উপরে যদি তোমাদের দেশের জয়ধ্বজা রোপণ করতে চাও, তা হলে দেশকে যারা ভালোবাসে তারা সেই ভয়ের শাসনের কাছে এক চুল মাথা নিচু করবে না। ইতিহাসে এম. এ. বললেন, এমন কোন দেশ আছে যেখানে রাজ্যশাসন ভয়ের শাসন নয় ? আমি বললুম, এই ভয়ের শাসনের সীমা কোন পর্যন্ত সেইটের দ্বারাই দেশের মানুষ কতটা স্বাধীন জানা যায়। ভয়ের শাসন যদি চুরিডাকাতি এবং পরের প্রতি অন্যায়ের উপরেই টানা যায় তা হলে । বোঝা যায় যে প্রত্যেক মানুষকে অন্য মানুষের আক্রমণ থেকে স্বাধীন করবার জন্যেই এই শাসন। কিন্তু মানুষ নিজে কী কাপড় পরবে, কোন দােকান থেকে কিনবে, কী খাবে, কার সঙ্গে বসে খাবে, এও যদি ভয়ের শাসনে বাঁধা হয় তা হলে মানুষের ইচ্ছাকে একেবারে গােড়া ঘেঁষে অস্বীকার করা হয়। সেটাই হল মানুষকে মনুষ্যত্ব থেকে বঞ্চিত করা। . ইতিহাসে এম. এ. বললেন, অন্য দেশের সমাজেও কি ইচ্ছাকে গোড়া ঘেঁষে কাটবার কোথাও কোনো ব্যবস্থা নেই ? আমি বললুম, কে বললে নেই ? মানুষকে নিয়ে দাস-ব্যাবসা যে দেশে যে পরিমাণে আছে সে। পরিমাণেই মানুষ আপনাকে নষ্ট করছে। এম. এ. বললেন, তা হলে ঐ দাস-ব্যাবসাটা মানুষেরই ধর্ম, ওটাই মনুষ্যত্ব। বি. এ. বললেন, সন্দীপবাবু এ সম্বন্ধে সেদিন যে দৃষ্টান্ত দিলেন সেটা আমাদের মনে খুব লেগেছে। ঐ-যে ওপারে হরিশ কুণ্ডু আছেন জমিদার, কিংবা সানকিভােঙর চক্রবর্তীরা, ওঁদের সমস্ত এলেকা বঁটি দিয়ে আজ এক ছটাক বিলিতি নুন পাবার জো নেই। কেন ? কেননা বরাবরই ওঁরা জোরের উপরে চলেছেন, যারা স্বভাবতই দাস, প্ৰভু না থাকাটাই হচ্ছে তাদের সকলের চেয়ে বড়ো বিপদ । এফ. এ.-প্লাকড় ছােকরাটি বললে, একটা ঘটনা জানি, চক্রবর্তদের একটি কায়স্থ প্রজা ছিল। সে তার একটা হাট নিয়ে চক্রবর্তদের কিছুতে মানছিল না। মামলা করতে করতে শেষকালে তার এমন দশা হল যে খেতে পায় না। যখন দুদিন তার ঘরে হাঁড়ি চড়ল না তখন স্ত্রীর রুপের গয়না বেচিতে