পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

de R রবীন্দ্র-রচনাবলী সে চমকে দাড়ালো। কিন্তু তখনো সে আমার দিকে ফিরল না। আমি তার সামনে এসে দাঁড়ালুম। তার দিকে ছায়া, আমার মুখের উপর চাঁদের আলো পড়ল। সে দুই হাত মুঠো করে চােখ বুজে দাঁড়িয়ে রইল। আমি বললুম, বিমলা, আমার এই পিজারের মধ্যে চারি দিক বন্ধ, তোমাকে কিসের জন্যে এখানে ধরে রাখব ? এমন করে তো তুমি বঁাচবে না। বিমলা চোখ বুজেই রইল, একটি কথাও বললে না। আমি বললুম, তোমাকে যদি এমন জোর করে বেঁধে রাখি তা হলে আমার সমস্ত জীবন যে একটা লোহার শিকল হয়ে উঠবে। তাতে কি আমার কোনো সুখ আছে ? বিমলা চুপ করেই রইল। আমি বললুম, এই আমি তোমাকে সত্য বলছি, আমি তোমাকে ছুটি দিলুম। আমি যদি তোমার আর-কিছু না হতে পারি অন্তত আমি তোমার হাতের হাত-কড়া হব না। এই বলে আমি বাড়ির দিকে চলে গেলুম। না না, এ আমার ঔদার্য নয়, এ আমার ঔদাসীন্য তো নয়ই। আমি যে ছাড়তে না পারলে কিছুতেই ছাড়া পাব না। যাকে আমার হৃদয়ের হার করব তাকে চিরদিন আমার হৃদয়ের বোঝা করে রেখে দিতে পারব না । অন্তর্যামীর কাছে আমি জোড়হাতে কেবল । এই প্রার্থনাই করছি আমি সুখ না পাই নেই পেলুম, দুঃখ পাই সেও স্বীকার, কিন্তু আমাকে বেঁধে রেখে দিয়ে না । মিথ্যাকে সত্য বলে ধরে রাখার চেষ্টা যে নিজেরই গলা চেপে ধরা । আমার সেই আত্মহত্যা থেকে আমাকে বাচাও । বৈঠকখানার ঘরে এসে দেখি মাস্টারমশায় বসে আছেন। তখন ভিতরে ভিতরে আবেগে আমার মন দুলছে। মাস্টারমশায়কে দেখে আমি অন্য কোনাে কথা জিজ্ঞাসা করবার আগে বলে উঠলুম, মাস্টারমশায়, মুক্তিই হচ্ছে মানুষের সব চেয়ে বড়ো জিনিস। তার কাছে আর-কিছুই নেই, কিছুই না। মাস্টারমশায় আমার এই উত্তেজনায় আশ্চর্য হয়ে গেলেন। কিছু না বলে আমার দিকে চেয়ে রইলেন । আমি বললুম, বই পড়ে কিছুই বােঝা যায় না। শাস্ত্রে পড়েছিলুম ইচ্ছাটাই বন্ধন ; সে নিজেকে বঁধে, অন্যকে বাধে। কিন্তু, শুধু কেবল কথা ভয়ানক ফাঁকা। সত্যি যেদিন পাখিকে খাচা থেকে ছেড়ে দিতে পারি সেদিন বুঝতে পারি পাখিই আমাকে ছেড়ে দিলে। যাকে আমি খাচায় বাধি সে আমাকে আমার ইচ্ছেতে বাধে, সেই ইচ্ছের বাধন যে শিকলের বাধনের চেয়ে শক্ত । আমি আপনাকে বলছি, পৃথিবীতে এই কথাটি কেউ বুঝতে পারছে না। সবাই মনে করছে, সংস্কার আর কোথাও করতে হবে। আর কোথাও না, কোথাও না, কেবল ইচ্ছের মধ্যে ছাড়া । মাস্টারমশায় বললেন, আমরা মনে করি, যেটা ইচ্ছে করেছি সেটাকে হাতে করে পাওয়াই স্বাধীনতা ; কিন্তু আসলে, যেটা ইচ্ছে করেছি। সেটাকে মনের মধ্যে ত্যাগ করাই স্বাধীনতা । আমি বললুম, মাস্টারমশায়, অমন করে কথায় বলতে গেলে টাক-পড়া উপদেশের মতো শোনায় ; কিন্তু যখনই চােখে ওকে আভাসমাত্রেও দেখি তখন যে দেখি ঐটেই অমৃত । দেবতারা এইটেই পান করে অমর। সুন্দরকে আমরা দেখতেই পাই নে যতক্ষণ না তাকে আমরা ছেড়ে দিই। বুদ্ধই পৃথিবী জয় করেছিলেন, আলেকজাণ্ডার করেন নি, এ কথা যে তখন মিথ্যেকথা যখন এটা শুকনো গলায় বলি । এই কথা কবে গান গেয়ে বলতে পারব ? বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের এই-সব প্ৰাণের কথা ছাপার বইকে ছাপিয়ে পড়বে কবে, একেবারে গঙ্গোত্রী থেকে গঙ্গার নিবারের মতো ? ? হঠাৎ মনে পড়ে গেল মাস্টারমশায় ক'দিন ছিলেন না, কোথায় ছিলেন তা জানিও নে। একটু লজ্জিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলুম, আপনি ছিলেন কোথায় ? 呜 মাস্টারমশায় বললেন, পঞ্চুর বাড়িতে। ] - পষ্ণুর বাড়িতে ? এই চার দিন সেখানেই ছিলেন ? ) হাঁ, মনে ভাবলুম, যে মেয়েটি পঞ্চর মামী সেজে এসেছে তার সঙ্গেই কথাবার্তা কয়ে দেখব । আমাকে দেখে প্রথমটা সে একটু আশ্চর্য হয়ে গেল ; ভদ্রলোকের ছেলে হয়েও যে এতবড়ো অদ্ভুত