পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে - GGG হায় রে, আমিও সন্দীপের কাছে এমনি করে বলেছিলুম কেন পারব না। অমূল্যর বুক-ফোলানো দেখে একটুও আশ্বাস পেলুম না। জিজ্ঞাসা করলুম, কী করবে বলে দেখি । অমূল্য এমনি-সব আজগুবি প্ল্যান বলতে লািগল যে, সে মাসিক কাগজের ছােটাে গল্পে ছাড়া আর কোথাও প্রকাশ করবারই যোগ্য নয় । । আমি বললুম, না অমূল্য, ও সব ছেলেমানুষ রাখে। সে বললে, আচ্ছা, টাকা দিয়ে ঐ পাহারার লোকদের বশ করব । । টাকা পাবে কোথায় ? সে অন্নানিমুখে বললে, বাজার লুঠ করে। আমি বললুম, ও-সব দরকার নেই, আমার গয়না আছে তাই দিয়ে হবে। মূল ক’লে, কিন্তু আজাকির উপর খুব চলবে না। খুব একটা সহজ বিক্তি আছে। 9 সে আপনার শুনে কাজ নেই। সে খুব সহজ । তবু শুনি । অমূল্য কোর্তার পকেট থেকে প্রথমে একটা পকেট-এডিশন গীতা বের করে টেবিলের উপর রাখলে, তার পরে একটি ছােটাে পিস্তল বের করে আমাকে দেখালে, আর-কিছু বললে না। কী সর্বনাশ! আমাদের বুড়ো খাজাঞ্চিকে মারার কথা মনে করতে ওর এক মুহূৰ্তও দেরি হল না। ওর মুখখানি এমনতরো যে মনে হয়, একটা কাক মারাও ওর পক্ষে শক্ত, অথচ মুখের কথা একেবারে অন্য জাতের । আসল কথা, এই সংসারে বুড়ো খাজাঞ্চি যে কতখানি সত্য তা ও একেবারে দেখতে পাচ্ছে না, সেখানে যেন ফাঁকা আকাশ । সেই আকাশে প্ৰাণ নেই, ব্যথা নেই, কেবল শ্লোক আছে ; ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে । . আমি বললুম, বল কী অমূল্য! আমাদের রায়মশায়ের যে স্ত্রী আছে, ছেলেমেয়ে আছে, তার যে— স্ত্রী নেই, ছেলেমেয়ে নেই এমন মানুষ এ দেশে পাব কোথায় ? দেখুন, আমরা যাকে দয়া বলি সে কেবল নিজের পরেই দয়া, পাছে নিজের দুর্বল মনে ব্যথা লাগে সেইজন্যেই অন্যকে আঘাত করতে পারি নে, এই তো হল কাপুরুষতার চূড়ান্ত ! সন্দীপের মুখের বুলি বালকের মুখে শুনে বুক কেঁপে উঠল। ও যে নিতান্ত কঁাচা, ভালোকে ভালো । বলে বিশ্বাস করবারই যে ওর সময় । আহা, ওর যে বঁচবার বয়েস, বাড়বার বয়েস । আমার ভিতরে মা জেগে উঠল যে ! নিজের দিক থেকে আমার ভালোও ছিল না, মন্দও ছিল না, ছিল কেবল মরণ মধুর রূপ ধারে ; কিন্তু যখন এই আঠারো বছরের ছেলে এমন অনায়াসে মনে করতে পারলে একজন বুড়োমানুষকে বিনা দোষে মেরে ফেলাই ধর্ম তখন আমার গা শিউরে উঠল। যখন দেখতে পেলুম ওর মনে পাপ নেই তখন ওর এই কথার পাপ বড়ো ভয়ংকর হয়ে আমার কাছে দেখা দিলে । যেন বাপমায়ের অপরাধকে কচি ছেলের মধ্যে দেখতে পেলুম। বিশ্বাসে উৎসাহে ভরা বড়ো বড়ো ঐ দুটি সরল চােখের দিকে চেয়ে আমার প্রাণের ভিতর কেমন করতে লাগল। অজগর সাপের মুখের মধ্যে ঢুকতে চলেছে, একে কে বীচাবে ? আমার দেশ কেন সত্যিকার মা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে এই ছেলেটিকে বুকে চেপে ধরছে না ? কেন একে বলছে না, ‘ওরে বাছা, আমাকে তুই বঁচিয়ে কী করবি তোকে যদি বাঁচাতে না পারলুম' ? জানি জানি, পৃথিবীর বড়ো বড়ো প্ৰতাপ শয়তানের সঙ্গে রফা করে বেড়ে উঠেছে, কিন্তু মা যে আছে একলা দাঁড়িয়ে এই শয়তানের সমৃদ্ধিকে তুচ্ছ করবার জন্যে। মা তো কার্যসিদ্ধি চায় না, সে সিদ্ধি যতবড়ো সিদ্ধিই হােক, মা যে বঁাচাতে চায়। আজ আমার সমস্ত প্ৰাণ চাচ্ছে এই ছেলেটিকে দুই হাতে টেনে ধরে বঁাচাবার জন্যে । । কিছু আগেই ওকে ডাকাতি করতে বলেছিলুম, এখন যতবড়ো উল্টো কথাই বলি সেটাকে ও