পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

११’ রবীন্দ্র-রচনাবলী হয়ে পড়ে যাব । এখন সামনে রাস্তা ছাড়া রাস্তাই নেই। কত টাকা নিলুম তাই যে বসে বসে গুনব, সে আমি লজ্জায় পারলুম না। ও যেমন ঢাকা আছে তেমনি ঢাকা থাক, চুরির হিসেব করব না। শীতের অন্ধকার রাত্রে আকাশে একটুও বাষ্প ছিল না ; সমস্ত তারাগুলি ঝক ঝক করছে। আমি ছাদের উপর শুয়ে শুয়ে ভাবছিলুম। দেশের নাম করে ঐ তারাগুলি যদি একটি একটি মোহরের মতো আমাকে চুরি করতে হত, অন্ধকারের বুকের মধ্যে সঞ্চিত ঐ তারাগুলি, তার পরদিন থেকে চিরকালের জন্যে রাত্রি একেবারে বিধবা, নিশীথের আকাশ একেবারে অন্ধ, তা হলে সে চুরি যে সমস্ত জগতের কাছ থেকে চুরি হত । আজ আমি এই-যে চুরি করে আনলুম এও তো টাকা-চুরি নয়, এ যে আকাশের চিরকালের আলো চুরিরই মতো ; এ চুরি সমস্ত জগতের কাছ থেকে চুরি, বিশ্বাস-চুরি, ধর্ম-চুরি । ছাদের উপর পড়ে রাত্রি কেটে গেল। সকালে যখন বুঝলুম আমার স্বামী এতক্ষণে উঠে চলে গেছেন তখন সর্বাঙ্গে শাল মুড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে ঘরের দিকে চললুম। তখন মেজোরানী ঘটিতে করে তার বারান্দার টবের গাছ-ক’টিতে জল দিচ্ছিলেন । আমাকে দেখেই বলে উঠলেন, ওলো আমি চুপ করে দাঁড়ালুম, আমার বুকের মধ্যে কঁপতে লাগল ! মনে হতে লাগল, আঁচলে বাধা গিনিগুলো শালের ভিতর থেকে বড়ো বেশি উচু হয়ে আছে। মনে হল, এখনই আমার কাপড় ছিড়ে গিনিগুলো বারান্দাময় ঝন ঝন করে ছড়িয়ে পড়বে, নিজের ঐশ্বৰ্য চুরি করে ফতুর হয়ে গেছে এমন চোর আজ এই বাড়ির দাসী-চাকরীদের কাছেও ধরা পড়ে যাবে। চিঠি লিখেছে । আমি চোরের মতোই চুপ করে দাড়িয়ে রইলুম | আমি ঠাকুরপোকে বলছিলুম তোমার শরণাপন্ন হতে । দেবী, প্রসন্ন হও গো, তোমার দলবল ঠেকাও । আমরা তোমার বন্দেমাতরমের শিন্নি মানছি। দেখতে দেখতে অনেক কাণ্ডই তো হল, এখন দোহাই তোমার, ঘরে সিদটা ঘটতে দিয়ে না । আমি কিছু না বলে তাড়াতাড়ি আমার শোবার ঘরে চলে গেলুম । চোরাবালিতে পা দিয়ে ফেলেছি, আর ওঠবার জো নেই, এখন যত ছটফট করব ততই ডুবতে থাকব । এ টাকাটা এক্ষনি আমার আঁচল থেকে খসিয়ে সন্দীপের হাতে দিয়ে ফেলতে পারলে বাচি, এ বোঝা আমি আর বইতে পারি নে, আমার পাজরা যেন ভেঙে যাচ্ছে । সকালবেলাতেই খবর পেলুম সন্দীপ আমার জন্যে অপেক্ষা করছে । আজ আর আমার সাজসজ্জা ছিল না, শাল মুড়ি দিয়ে তাড়াতাড়ি বাইরে চলে গেলুম। ঘরের মধ্যে ঢুকেই দেখি সন্দীপের সঙ্গে অমূল্য বসে আছে। মনে হল আমার মানসম্রাম যা-কিছু বাকি ছিল সমস্ত যেন ঝিম ঝিম করে আমার গা বেয়ে নেবে গিয়ে পায়ের তলা দিয়ে একেবারে মাটির মধ্যে চলে গেল ! নারীর চরম অমর্যাদা ঐ বালকের সামনে আজ আমাকে উদঘাটিত করে দিতে হবে । আমার এই চুরির কথা এরা আজ দলের মধ্যে বসে আলোচনা করছে ! এর উপরে অল্প একটুখানিও আবরু রাখতে দেয় নি । পুরুষমানুষকে আমরা বুঝবে না । ওরা যখন ওদের উদ্দেশ্যের রথ টানবার পথ তৈরি করতে বসে তখন বিশ্বের হৃদয়কে টুকরো টুকরো করে ভেঙে পথের খোওয়া বিছিয়ে দিতে ওদের একটু ও বাধে না । ওরা নিজের হাতে সৃষ্টি করবার নেশায় যখন মেতে ওঠে তখন সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিকে চুরমার করতেই ওদের আনন্দ ; আমার এই মর্মান্তিক লজ্জা ওদের চোখের কোণেও পড়বে না, প্রাণের পরে দরদ নেই ওদের, ওদের যত ব্যগ্রত সব উদ্দেশ্যের দিকে । হায় রে, এদের কাছে আমি কেই বা ! বন্যার মুখের কাছে একটা মেঠো ফুলের মতো ।