পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে (kÖ፩ কিন্তু আমাকে এমন করে নিবিয়ে ফেলে সন্দীপের লাভ হল কী ? এই পাঁচ হাজার টাকা ? কিন্তু আমার মধ্যে পাঁচ হাজার টাকার চেয়ে বেশি কিছু ছিল না কি ? ছিল বৈকি। সেই খবর তো সন্দীপের কাছেই শুনেছিলুম, আর সেই শুনেই তো আমি সংসারের সমস্তকে তুচ্ছ করতে পেরেছিলুম। আমি আলো দেব, আমি জীবন দেব, আমি শক্তি দেব, আমি অমৃত দেব, সেই বিশ্বাসে সেই আনন্দে দুই কূল ছাপিয়ে আমি বাহির হয়ে পড়েছিলুম। আমার সেই আনন্দকে যদি কেউ পূর্ণ করে তুলত তা হলে আমি মরে গিয়েও বীচিতুম, আমার সমস্ত সংসার ভাসিয়ে দিয়েও আমার লোকসান হত না। আজ কি এরা বলতে চায় এ সমস্তই মিথ্যে কথা ? আমার মধ্যে যে দেবী আছে ভক্তকে বরাভয় দেবার শক্তি তার নেই ? আমি যে স্তবগান শুনেছিলুম, যে গান শুনে স্বৰ্গ হতে ধুলোয় নেমে এসেছিলুম, সে কি এই ধুলোকে স্বৰ্গ করবার জন্যে নয় ? সে কি স্বৰ্গকেই মাটি করবার জন্যে ? সন্দীপ আমার মুখের দিকে তার তীব্র দৃষ্টি রেখে বললে, টাকা চাই রানী ! অমূল্য আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল, সেই বালক, সে আমার মায়ের গর্ভে জন্মায় নিবটে, কিন্তু সে তার মায়ের গর্ভে জন্মেছিল- সেই মা, সে যে একই মা ! আহা, ঐ কচি মুখ, ঐ স্নিগ্ধ চােখ, ঐ তরুণ বয়েস ! আমি মেয়েমানুষ, আমি ওর মায়ের জাত, ও আমাকে বললে কিনা ‘আমার হাতে বিষ তুলে দাও, আর আমি ওর হাতে বিষই তুলে দেব ! টাকা চাই রানী !-- রাগে লজ্জায় আমার ইচ্ছে হল সেই সোনার বােঝা সন্দীপের মাথার উপর ছুড়ে ফেলে দিই। আমি কিছুতেই আঁচলের গিরে যেন খুলতে পারছিলুম না, থারথার করে আমার আঙুলগুলো কঁাপিতে লাগল। তার পর টেবিলের উপর সেই কাগজের মোড়কগুলো যখন পড়ল তখন সন্দীপের মুখ কালো হয়ে উঠল। সে নিশ্চয় ভাবলে ঐ মোড়কগুলোর মধ্যে আধুলি আছে। কী ঘূণা ! অক্ষমতার উপরে কী নিষ্ঠুর অবজ্ঞা! মনে হল ও যেন আমাকে মারতে পারে। সদীপ ভাবলে, আমি বুঝি ওর সঙ্গে দর করতে বসেছি, ওর পঁাচ হাজার টাকার দাবি দু-তিন শো টাকা দিয়ে রফা করতে চাই। একবার মনে হল, এই মোড়কগুলো নিয়ে ও জানলার বাইরে ছুড়ে ফেলে দেবে। ও কি ভিক্ষুক ? ও যে রাজা ! অমূল্য জিজ্ঞাসা করলে, আর নেই রানীদিদি ? করুণায় ভরা তার গলা। আমার মনে হল আমি বুঝি চীৎকার করে কেঁদে উঠব। প্রাণপণে হৃদয়কে যেন চেপে ধরে একটু কেবল ঘাড় নাড়লুম। সদীপ চুপ করে রইল ; মোড়কগুলো ছুলেও না, একটা কথাও বললে না । চলে যাব ভাবছি, কিন্তু কিছুতেই আমার পা চলছে না। পৃথিবী দুফাক হয়ে আমাকে যদি টেনে নিত তা হলেই এই মাটির পিণ্ড মাটির মধ্যে আশ্রয় পেয়ে বঁাচত । আমার অপমান ঐ বালকের বুকে গিয়ে বাজল। সে হঠাৎ খুব একটা আনন্দের ভান করে বলে । উঠল, এই কম কী ! এতেই ঢ়ের হবে । তুমি আমাদের বঁচিয়েছ রানীদিদি। বলেই সে একটা মোড়ক খুলে ফেললে, গিনিগুলো ঝক ঝক করে উঠল। এক মুহুর্তে সন্দীপের মুখের যেন একটা কালো মোড়ক খুলে গেল। তারও মুখ চােখ আনন্দো ঝাক ঝক করতে লাগল। মনের ভিতরকার এই হঠাৎ উল্টো হাওয়ার দমকা সামলাতে না পেরে সে চৌকি থেকে লাফিয়ে উঠে আমার কাছে ছুটে এল। কী তার মতলব ছিল জানি নে। আমি বিদ্যুতের মতো অমূল্যের মুখের দিকে একবার চেয়ে দেখলুম, হঠাৎ একটা চাবুক খেয়ে তার মুখ যেন বিবৰ্ণ হয়ে গেছে। আমি আমার সমস্ত শক্তি নিয়ে সন্দীপকে ঠেলা দিলুম। পাথরের টেবিলের উপর মাথাটা তার ঠক করে ঠেকল, তার পরে সেখান থেকে সে মাটিতে পড়ে গেল, কিছুক্ষণ তার আর সাড়া রইল না। এই প্রবল চেষ্টার পরে আমার শরীরে আর একটুও বল ছিল না, আমি চৌকির উপরে বসে পড়লুম। অমূল্যের মুখ আনন্দে দীপ্ত হয়ে উঠল, সে সন্দীপের দিকে ফিরেও তাকালে না, আমার পায়ের ধুলো নিয়ে আমার পায়ের কাছে বসল। ওরে ভাই, ওরে বাছা, তোর এই শ্রদ্ধাটুকু আজ আমার শূন্য বিশ্বপাত্রের শেষ সুধাবিন্দু। আর আমি পারলুম না, আমার কান্না ভেঙে পড়ল। আমি দুই হাতে আঁচল