পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(፩ግ S রবীন্দ্র-রচনাবলী ইতিহাসে সেও অমর হবে। সেই সত্যের অনুভূতি জগতের মধ্যে এই ভারতবর্ষেই খাটি হয়ে উঠক শয়তানের অভ্ৰভেদী অট্টহাসির মাঝখানে । কিন্তু বিদেশ থেকে এ কী পাপের মহামারী এসে আমাদের দেশে প্রবেশ করলে ! সমস্ত দিন এই সব নানা হাঙ্গামে কেটে গেল। শ্ৰান্ত হয়ে রাত্রে শুতে গেলুম। সেই টাকাটা আজ বের না করে কাল সকালে বের করে নেব স্থির করেছি। রাত্রে কখন এক সময়ে ঘুম ভেঙে গেল। ঘর অন্ধকার । একটা কিসের শব্দ যেন শুনতে পাচ্ছি। বুঝি কেউ কান্দছে। থেকে থেকে বাদলা-রাতের দমকা হাওয়ার মতো চোখের জলে ভরা এক-একটা দীর্ঘনিশ্বাস শুনতে পাচ্ছি। আমার মনে হল, আমার এই ঘরটার বুকের ভিতরকার কান্না | আমার ঘরে আর-কেউ নেই। বিমলা কিছুদিন থেকে কোনো-একটা পাশের ঘরে শোয় । আমি বিছানা থেকে উঠে পড়লুম। বাইরের বারান্দায় গিয়ে দেখি বিমলা মাটির উপর উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে । এ-সব কথা লিখতে পারা যায় না । এ যে কী, তা কেবল তিনিই জানেন যিনি বিশ্বের মর্মের মধ্যে বসে জগতের সমস্ত বেদনাকে গ্রহণ করছেন । আকাশ মূক, তারাগুলি নীরব, রাত্রি নিস্তব্ধ— তারই মাঝখানে ঐ একটি নিদ্রাহীন কান্না ! আমরা এই সব সুখদুঃখকে সংসারের সঙ্গে শাস্ত্রের সঙ্গে মিলিয়ে ভালো মন্দ একটা-কিছু নাম দিয়ে চুকিয়ে ফেলে দিই। কিন্তু অন্ধকারের বক্ষ ভাসিয়ে দিয়ে এই-যে বাথার উৎস উঠছে এর কি কোনাে নাম আছে! সেই নিশীথরাত্রে সেই লক্ষকোটি তারার নিঃশব্দতার মাঝখানে দাড়িয়ে আমি যখন ওর দিকে চেয়ে দেখলুম। তখন আমার মন সভয়ে বলে উঠল, আমি একে বিচার করবার কে ! হে প্ৰাণ, হে মৃত্যু, হে অসীম বিশ্ব, হে অসীম বিশ্বের ঈশ্বর, তোমাদের মধ্যে যে রহস্য রয়েছে আমি জোড়-হাতে তাকে প্ৰণাম করি । একবার ভাবলুম ফিরে যাই । কিন্তু পারলুম না । নিঃশব্দে বিমলার শিয়রের কাছে বসে তার মাথার উপর হাত রাখলুম। প্রথমটা তার সমস্ত শরীর কাঠের মতো শক্ত হয়ে উঠল, তার পরেই সে কঠিনতা যেন ফেটে ভেঙে কান্না সহস্রধারায় বয়ে যেতে লাগল ! মানুষের হৃদয়ের মধ্যে এত কান্না যে কোথায় ধরতে পারে সে তো ভেবে পাওয়া যায় না । আমি আস্তে আস্তে বিমলার মাথায় হাত বুলোতে লাগলুম। তার পরে কখন এক সময়ে হাৎড়ে । হাৎড়ে সে আমার পা-দুটাে টেনে নিলে, বুকের উপরে এমনি করে চেপে ধরলে যে আমার মনে হল সেই আঘাতে তার বুক ফেটে যাবে। বিমলার আত্মকথা আজ সকালে অমূল্যর কলকাতা থেকে ফেরার কথা। বেহারাকে বলে রেখেছি সে এলেই যেন খবর দেয় । কিন্তু, স্থির থাকতে পারছি নে । বাইরে বৈঠকখানায় গিয়ে বসে রইলুম | অমূল্যকে যখন আমার গয়না বেচবার জন্যে কলকাতায় পাঠলুম। তখন নিজের কথা ছাড়া আর কোনো কথা বুঝি মনেই ছিল না। এ কথা একবারও আমার বুদ্ধিতে এলই না যে সে ছেলেমানুষ, অত টাকার গয়না কোথাও বেচিতে গেলে সবাই তাকে সন্দেহ করবে । মেয়েমানুষ আমরা এত অসহায় যে আমাদের নিজের বিপদ অন্যের ঘাড়ে না। চাপিয়ে আমাদের যেন উপায় নেই। আমরা মরবার সময়