পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(፩ዒbr রবীন্দ্র-রচনাবলী আচ্ছা, তুমিই কলকাতায় চলো, আমিই তোমার অনুচর হব। কলকাতায় আমার কােজ নেই। সেইজন্যেই তো কলকাতায় যাওয়া তোমার দরকার । এখানে তোমার বড় বেশি কাজ । আমি তো নড়ছি নে । তা হলে তোমাকে নড়াতে হবে । জোর ? হঁহা, জোর । আচ্ছা বেশ, নড়ব। কিন্তু জগৎটা তো কলকাতা আর তোমার এলেকা এই দুই ভাগে বিভক্ত নয় । ম্যাপে আরো জায়গা আছে । তোমার গতিক দেখে মনে হয়েছিল, জগতে আমার এলেকা ছাড়া আর-কোনো জায়গাই নেই। সন্দীপ তখন দাড়িয়ে উঠে বললে, মানুষের এমন অবস্থা আসে যখন সমস্ত জগৎ এতটুকু জায়গায় এসে ঠেকে । তোমার এই বৈঠকখানাটির মধ্যে আমার বিশ্বকে আমি প্রত্যক্ষ করে দেখেছি, সেইজন্যেই এখান থেকে নড়ি নে । মক্ষীরানী, আমার কথা এরা কেউ বুঝতে পারবে না, হয়তো তুমিও বুঝবে না। আমি তোমাকে বন্দনা করি । আমি তোমারই বন্দনা করতে চললুম ! তোমাকে দেখার পর থেকে আমার মন্ত্র বদল হয়ে গেছে। বন্দে মাতরং নয়— বন্দে প্ৰিয়াং, বন্দে মোহিনীং । মা আমাদের রক্ষা করেন, প্রিয়া আমাদের বিনাশ করেন— বড়ো সুন্দর সেই বিনাশ | সেই মরণানুতোর নূপুর-ঝংকার বাজিয়ে তুলেছ আমার হৃৎপিণ্ডে । এই কোমলা সুজলা সুফলা মলয়জশীতলা বাংলাদেশের রূপ তুমি তোমার এই ভক্তের চক্ষে এক মুহুর্তে বদলে দিয়েছ। দয়ামায়া তোমার নেই গো ; এসেছ মোহিনী, তুমি তোমার বিষপাত্র নিয়ে ; সেই বিষ পান করে, সেই বিষে জর্জর হয়ে, হয় মরব নয় মৃত্যুঞ্জয় হব । মাতার দিন আজ নেই । প্রিয়া প্রিয়া প্রিয়া ! দেবতা স্বৰ্গ ধর্ম সত্য সব তুমি তুচ্ছ করে দিয়েছ, পৃথিবীর আর-সমস্ত সম্বন্ধ আজ ছায়া, নিয়ম-সংযমের সমস্ত বন্ধন আজ ছিন্ন। প্রিয়া প্রিয়া প্রিয়া ! তুমি যে দেশে দুটি পা দিয়ে দাঁড়িয়েছ তার বাইরের সমস্ত পৃথিবীতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে তারই ছাইয়ের উপর আনন্দে তাণ্ডবনৃত্য করতে পারি । এরা ভালোমানুষ, এরা অত্যন্ত ভালো, এরা সবার ভালো করতে চায়— যেন সবই সত্য ! কখনোই না, এমন সত্য বিশ্বে আর কোথাও নেই, এই আমার একমাত্র সত্য । বন্দনা করি তোমাকে ! তোমার প্রতি নিষ্ঠা আমাকে নিষ্ঠুর করেছে, তোমার 'পরে ভক্তি আমার মধ্যে প্রলয়ের আগুন জ্বলিয়েছে ! আমি ভালো নাই, আমি ধাৰ্মিক নই, আমি পৃথিবীতে কিছুই মানি নে, আমি যাকে সকলের চেয়ে প্রত্যক্ষ করতে পেরেছি। কেবলমাত্র তাকেই भानि । আশ্চর্য! আশ্চর্য! এই কিছু-আগেই আমি একে সমস্ত মন দিয়ে ঘূণা করেছিলুম। যাকে ছাই বলে দেখেছিলুম তার মধ্যে থেকে আগুন জ্বলে উঠেছে। এ একেবারে খাটি আগুন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিধাতা এমন করে মিশিয়ে কেন মানুষকে তৈরি করেন ? সে কি কেবল তার অলৌকিক ইন্দ্ৰজাল দেখাবার জন্যে ? আধা ঘণ্টা আগেই আমি মনে মনে ভাবছিলুম এই মানুষটাকে একদিন রাজা বলে ভ্রম হয়েছিল বটে কিন্তু এ যাত্রার দলের রাজা । তা নয়, তা নয়, যাত্রার দলের পোশাকের মধ্যেও এক-এক সময়ে রাজা লুকিয়ে থেকে যায়। এর মধ্যে অনেক লোভ, অনেক স্কুল, অনেক ফাকি আছে, স্তরে স্তরে মাংসের মধ্যে এ ঢাকা ; কিন্তু তবুও— আমরা জানি নে, আমরা শেষ কথাটাকে জানি নে, এইটেই স্বীকার করা ভালো ; আপনাকেও জানি নে। মানুষ বড়ো আশ্চর্য ; তাকে নিয়ে কী প্রচণ্ড রহস্যই তৈরি হচ্ছে তা সেই রুদ্র দেবতাই জানেন ! মাঝের থেকে দগ্ধ হয়ে গেলুম। প্ৰলয় ! প্রলয়ের কিছুদিন থেকে বারে বারে মনে হচ্ছে আমার দুটাে বুদ্ধি আছে। আমার একটা বুদ্ধি বুঝতে পারছে সন্দীপের এই প্রলয়রূপ ভয়ংকর ; আর-এক বুদ্ধি বলছে এই তো মধুর। জাহাজ যখন ডোবে তখন