পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

。(?brの রবীন্দ্র-রচনাবলী বিশ্বাস করতে পারো না ! কাছারি লুঠ করবে। এইটেই বা বিশ্বাস করতে কে পারত ? কোনো জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে পুলিপিঠের মধ্যে নারকেলের পুর দিতে লাগলুম। আমার মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে তিনি বললেন, যাই, ঠাকুরপোকে ডেকে পাঠাই, আমাদের সেই ছ হাজার টাকাটা এখনই বের করে নিয়ে কলকাতায় পাঠাতে হবে, আর দেরি করা নয় । এই বলে তিনি চলে যেতেই আমি পিঠের বারকোশ সেইখানে আলগা ফেলে রেখে তাড়াতাড়ি সেই লোহার সিন্দুকের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলুম। আমার স্বামীর এমনি ভোলা-মন যে দেখি তার যে জামার পকেটে চাবি থাকে সে জামােটা তখনো আলনায় বুলিছে ! চাবির রিং থেকে লোহার সিন্দুকের চাবিটা খুলে আমার জ্যাকেটের মধ্যে লুকিয়ে ফেললুম! : এমন সময় বাইরে থেকে দরজায় ধাক্কা পড়ল । বললুম, কাপড় ছাড়ছি। — শুনতে পেলুম মেজোরানী বললেন, এই কিছু আগে দেখি পিঠে তৈরি করছে, আবার এখনই সাজ করবার ধুম পড়ে গেল ! কত লীলাই যে দেখব ! আজি বুঝি ওদের বন্দেমাতরমের বৈঠক বসবে । ওলো, ও কী মনে করে একবার আস্তে আস্তে লোহার সিন্দূকটা খুললুম ! বোধ হয় মনে ভাবছিলুম। যদি সমস্তটা স্বপ্ন হয়, যদি হঠাৎ সেই ছোটাে দেরাজটা টেনে খুলতেই দেখি সেই কাগজের মোড়কগুলি ঠিক তেমনিই সাজানো রয়েছে। হায় রে, বিশ্বাসঘাতকের নষ্ট বিশ্বাসের মতোই সব শূন্য । মিছামিছ কাপড় ছাড়তেই হল । কোনো দরকার নেই, তবু নতুন করে চুল বাধালুম । মেজোরানীর সঙ্গে দেখা হতেই তিনি যখন জিজ্ঞাসা করলেন ‘বলি এত সাজ কিসের আমি বললুম, জন্মতিথির । মেজোরানী হেসে বললেন, একটা কিছু ছুতো পেলেই আমনি সাজ । ঢের দেখেছি, তোর মতো এমন ভাবুনে দেখি নি । অমূল্যকে ডাকবার জন্যে বেহারিার খোজ করছি, এমন সময় সে এসে পেনসিালে লেখা একটি ছোটাে চিঠি আমার হাতে দিলে। তাতে অমূল্য লিখেছে, দিদি, খেতে ডেকেছিলে, কিন্তু সৰ্বর করতে পারলুম না । আগে তোমার আদেশ পালন করে আসি, তার পরে তোমার প্রসাদ গ্রহণ করব | হয়তো অমূল্য কার হাতে টাকা ফেরাতে চলল, আবার কোন জালের মধ্যে নিজেকে জড়াতে গেল ! আমি তাকে তীরের মতো কেবল ছুড়তেই পারি, কিন্তু লক্ষ্য ভুল হলে তাকে আর কোনোমতে ফেরাতে পাির (N এই অপরাধের মূলে যে আমি আছি। এই কথাটা এখনই স্বীকার করা আমার উচিত ছিল । কিন্তু মেয়েরা সংসারে বিশ্বাসের উপরেই বাস করে, সেই যে তাদের জগৎ | সেই বিশ্বাসকে লুকিয়ে ফার্কি দিয়েছি। এই কথাটা জানিয়ে তার পরে সংসারে টিকে থাকা আমাদের পক্ষে বড়ো কঠিন । যা আমরা: ভাঙিব ঠিক তার উপরেই যে আমাদের দাড়াতে হবে, সেই ভাঙা জিনিসের খোচা নড়তে-চড়তে আমাদের প্রতি মুহূর্তেই বাজতে থাকবে । অপরাধ করা শক্ত নয়, কিন্তু সেই অপরাধের সংশোধন করা মেয়েদের পক্ষে যত কঠিন এমন আর কারও নয় । কিছুদিন থেকে আমার স্বামীর সঙ্গে বেশ সহজে কথাবার্তা কওয়ার প্রণালীটাি বন্ধ হয়ে গেছে । তাই হঠাৎ এতবড়ো একটা কথা কেমন করে এবং কখন যে তাকে বলব তা কিছুতেই ভেবে পেলুম না ; আজ তিনি অনেক দেরিতে খেতে এসেছেন ; তখন বেলা দুটাে । অন্যমনস্ক হয়ে কিছুই প্রায় খেতে পারলেন না। আমি যে তাকে একটু অনুরোধ করে খেতে বলব সে অধিকারটুকু খুইয়েছি । মুখ ফিরিয়ে আঁচলে চোখের জল মুছলুম। একবার ভাবলুম সংকোচ কাটিয়ে বলি, ঘরের মধ্যে একটু বিশ্রাম করে 'সে, তোমাকে বড়ো ক্লান্ত দেখাচ্ছে । একটু কেশে কথাটা যেই তুলতে যাচ্ছি এমন সময় বেহার এসে খবর দিলে দারোগীবাবু কাসেম সর্দারকে নিয়ে এসেছে । আমার স্বামী উদবিগ্নমুখে তাড়াতাড়ি উঠে চলে গেলেন । তিনি বাইরে যাওয়ার একটু পরেই মেজোরানী এসে বললেন, ঠাকুরপো কখন খেতে এলেন