পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(፩፩ O রবীন্দ্র-রচনাবলী বিধাতা আমাদের জীবন-ছবির দাগ একটু ঝাপসা করেই টেনে দেন ; আমরা নিজের হাতে সেটাকে কিছু-কিছু বদলে মুছে পুরিয়ে দিয়ে নিজের মনের মতো একটা স্পষ্ট চেহারা ফুটিয়ে তুলব। এই তীর অভিপ্ৰায় । সৃষ্টিকর্তার ইশারা নিয়ে নিজের জীবনটাকে নিজে সৃষ্টি করে তুলব, একটা বড়ো আইডিয়াকে আমার সমস্তর মধ্য দিয়ে ব্যক্ত করে দেখােব, এই বেদনা বরাবর আমার মনে আছে। এই সাধনাতে এতদিন কাটিয়েছি। প্রবৃত্তিকে কত বঞ্চিত করেছি, নিজেকে কত দমন করেছি, সেই অন্তরের ইতিহাস অন্তর্যামীই জানেন । শক্ত কথা এই যে, কারও জীবন একলার জিনিস নয় ; সৃষ্টি যে করবে। সে নিজের চার দিককে নিয়ে যদি সৃষ্টি না করে তবে ব্যর্থ হবে । মনের মধ্যে তাই একান্ত একটা প্ৰয়াস ছিল যে বিমলকেও এই রচনার মধ্যে টানব । সমস্ত প্ৰাণ দিয়ে তাকে ভালো যখন বাসি তখন কেন পারব না, এই ছিল আমার জোর । এমন সময় স্পষ্ট দেখতে পেলুম নিজের সঙ্গে সঙ্গে নিজের চার দিককে যারা সহজেই সৃষ্টি করতে পারে তারা এক জাতের মানুষ, আমি সে জাতের না। আমি মন্ত্র নিয়েছি, কাউকে মন্ত্র দিতে পারি নি । যাদের কাছে আপনাকে সম্পূর্ণ ঢেলে দিয়েছি তারা আমার আর-সবই নিয়েছে, কেবল আমার এই অন্তরতম জিনিসটি ছাড়া । আমার পরীক্ষা কঠিন হল । সব চেয়ে যেখানে সহায় চাই সব চেয়ে সেখানেই একলা হলুম। এই পরীক্ষাতেও জিতব, এই আমার পণ রইল। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমার দুৰ্গম পথ আমার একলারই পথ । আজি সন্দেহ হচ্ছে আমার মধ্যে একটা অত্যাচার ছিল । বিমলের সঙ্গে আমার সম্বন্ধটিকে একটা সুকঠিন ভালোর ছাচে নিখুঁত করে ঢালাই করব আমার ইচ্ছার ভিতরে এই একটা জবৰ্দস্তি আছে । কিন্তু মানুষের জীবনটা তো ছাঁচে ঢালবার নয় । আর, ভালোকে জড়বস্তু মনে করে গড়ে তুলতে গেলেই মরে গিয়ে সে তার ভয়ানক শোধ নেয় । এই জুলুমের জন্যেই আমরা পরস্পরের সঙ্গে ভিতরে ভিতরে তফাত হয়ে গেছি তা জানতেই পারি নি। বিমল নিজে যা হতে পারত তা আমার চাপে উপরে ফুটে উঠতে পারে নি বলেই নীচের তল থেকে রুদ্ধ জীবনের ঘর্ষণে বাধা খইয়ে ফেলেছে। এই ছ হাজার টাকা আজ ওকে চুরি করে নিতে হয়েছে ; আমার সঙ্গে ও স্পষ্ট ব্যবহার করতে পারে নি, কেননা ও বুঝেছে এক জায়গায় আমি ওর থেকে প্রবলরাপে পৃথক | আমাদের মতো একরোখা আইডিয়ার মানুষের সঙ্গে যারা মেলে তারা মেলে, যারা মেলে না তারা আমাদের ঠকায় । সরল মানুষকেও আমরা কপট করে তুলি । আমরা সহধর্মিণীকে গড়তে গিয়ে স্ত্রীকে বিকৃত করি । আবার কি সেই গোড়ায় ফেরা যায় না ? তা হলে একবার সহজের রাস্তায় চলি । আমার পথের সঙ্গিনীকে এবার কোনো আইডিয়ার শিকল দিয়ে বাধতে চাইব না ; কেবল আমার ভালোবাসার বঁাশি বাজিয়ে বলব, তুমি আমাকে ভালোবাসো, সেই ভালোবাসার আলোতে তুমি যা তারই পূর্ণ বিকাশ হোক, আমার ফর্মশা একেবারে চাপা পড়ক, তোমার মধ্যে বিধাতার যে ইচ্ছা আছে তারই জয় হোক— আমার ইচ্ছা লজিত হয়ে ফিরে যাক । কিন্তু আমাদের মধ্যেকার যে বিচ্ছেদটা ভিতরে ভিতরে জন্মছিল সেটা আজ এমনতরো একটা ক্ষতর মধ্যে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়েছে যে, আর কি তার উপর স্বভাবের শুশ্রুষা কাজ করতে পারবে ? যে আবারুর আড়ালে প্রকৃতি আপনার সংশোধনের কাজ নিঃশব্দে করে সেই আবরু যে একেবারে ছিন্ন হয়ে গেল । ক্ষতকে ঢাকা দিতে হয়, এই ক্ষতকে আমার ভালোবাসা দিয়ে ঢাকব ; বেদনাকে আমার হৃদয় দিয়ে পাকে পাকে জড়িয়ে বাইরের স্পর্শ থেকে আড়াল করে রাখব ; একদিন এমন হবে যে এই ক্ষতির চিহ্ন পর্যন্ত থাকবে না । কিন্তু, আর কি সময় আছে ? এতদিন গেল ভুল বুঝতে, আজকের দিন এল ভুল ভাঙতে, কতদিন লাগবে ভুল শোধরাতে ! তার পরে ? তার পরে ক্ষত শুকোতেও পারে, কিন্তু ক্ষতিপূরণ কি আর কোনো কালে হবে ? একটা কী খট করে উঠল । ফিরে তাকিয়ে দেখি, বিমল দরজার কাছ থেকে ফিরে যাচ্ছে। বোধ হয়। দরজার পাশে এসে এতক্ষণ চুপ করে দাড়িয়ে ছিল, ঘরে ঢুকবে কি না ঢুকবে ভেবে পাচ্ছিল না,