পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

vo8 রবীন্দ্র-রচনাবলী অবস্থা হয় কেন ? কোনদিন তুমি এবং তোমাদের সাহিত্য-সংসারের এই সার সঙটি বলিয়া বসিবেন, অসভ্য ভারতের বাতাসে অক্সিজেন বাস্পই ছিল না এবং বিদ্যুৎ খেলাইতে পারে ভারতের অশিক্ষিত আকাশ এমন এনলাইটেণ্ড ছিল না। ভাই বাঙালি, তুমি এনলাইটেণ্ড, বাতাসের সঙ্গে তুমি অনেক অক্সিজেন বাষ্প টানিয়া থাক এবং তোমার চোখে মুখে বিদ্যুৎ খেলে। আমি মুর্থ আমি কুসংস্কারাচ্ছন্ন তাই, ভাই, আমি বিশ্বাস করি প্রাচীন ভারতে গ্যালভানিক ব্যাটারি ছিল এবং অক্সিজেন বাষ্পের অস্তিত্বও অবিদিত ছিল না। কেন বিশ্বাস করি ? আগে নিষ্ঠার সহিত কুর্মকন্ধি ও স্কন্দ পুরাণ পাঠ করে, গো এবং ব্রাহ্মণের প্রতি ভক্তি স্থাপন করো, স্নেচ্ছের অন্ন যদি খাইতে ইচ্ছা হয় তো গোপনে খাইয়া সমাজে অস্বীকার করো, যতটুকু নব্য শিক্ষা হইয়াছে সম্পূর্ণ ভুলিয়া যাও, তবে বুঝিতে পরিবে কেন বিশ্বাস করি। আজ তোমাকে যাহা বলিব তুমি হাসিয়া উড়াইয়া দিবে। আমার যুক্তিতোমার কাছে অজ্ঞের প্রলপ বলিয়া প্রতীয়মান হইবে। তবু একবার জিজ্ঞাসা করি, কীটে যতটা খাইয়াছে এবং মুসলমানে যতটা ধ্বংস করিয়াছে, তাহার কি একটা হিসাব আছে! যে পাপিষ্ঠ যবন ভারতের পবিত্র স্বাধীনতা নষ্ট করিয়াছে, ভারতের গ্যালভানিক ব্যাটারির প্রতি যে তাহারা মমতা প্রদর্শন করিবে ইহাও কি সম্ভব ! যে স্নেচ্ছগণ শত শত আৰ্যসন্তানের পবিত্র মস্তক উষ্ণীষ ও শিখা -সমেত উড়াইয়া দিয়াছিল, তাহারা যে আমাদের পবিত্র এই তো গেল প্রথম যুক্তি। দ্বিতীয় যুক্তি এই যে, যদি যবনগণের দ্বারাই গ্যালভানিক ব্যাটারি ও অক্সিজেনের প্রাচীন নাম লোপ না হইবে, তবে তাহা গেল কোথায়- তবে কোথাও তাহার কোনো চিহ্ন দেখা যায় না কেন ? প্রাচীন শাস্ত্রে এত শত ঋষি-মুনির নাম আছে, তন্মধ্যে গন্ধন ঋষির নাম বহু গবেষণাতেও পাওয়া যায় না কেন ? যে পবিত্র ভারতে দধীচি ৱজনির্মাণের জন্য নিজ অস্থি ইন্দ্রকে দান করিয়াছেন, ভীমসেন গদাঘাতের দ্বারা জরাসন্ধকে নিহত করিয়াছেন এবং জকুমুনি গঙ্গাকে এক গণ্ডুষে পান করিয়া জানু দিয়া নিঃসারিত করিয়াছেন, যে ভারতে ঋষিবাক্যপালনের জন্য বিন্ধাপর্বত আজিও নতশির, সেই ভারতের সাহিত্য হইতে অক্সিজেন বাম্পের নাম পর্যন্ত যে লুপ্ত হইয়াছে, সর্বসংহারক যবনের উপদ্ৰবই যদি তাহার কারণ না হয়, তবে হে ভাই বাঙালি, তাহার কী কারণ আছে জিজ্ঞাসা করি । তৃতীয় যুক্তি এই যে ইতিহাসের দ্বারা সম্পূর্ণ প্রমাণ হইয়া গিয়াছে যে, যবনেরা প্রাচীন ভারতের বহুতর কীর্তি লোপ করিয়াছে। এ কথা আজ কেহই অস্বীকার করিতে পরিবেন না। আজ যে আমরা নিন্দিত অপমানিত ভীত ত্ৰস্ত ভয়গ্ৰস্ত রিক্তহস্ত অস্তংগমিতমহিমা পরাধীন হইয়াছি, ভারতের যবনাধিকারই তাহার একমাত্র কারণ। এতটা দূরই যদি স্বীকার করিতে পারিলাম, তবে আমাদের গ্যালভানিক ব্যাটারি ও অক্সিজেনের নামও যে সেই দুরাত্মারাই লোপ করিয়াছে এটুকু যোগ করিয়া দিতে কুষ্ঠিত হইবার তিলমাত্র কারণ দেখি না। r চতুর্থ যুক্তি, যখন এক সময়ে যবন ভারত অধিকার করিয়াছিল এবং নির্বিচারে বহুতর পূত মস্তক ও মন্দির চূড়া ভগ্ন করিয়াছিল, যখন অনায়াসে যবনের স্কন্ধে সমস্ত দােষরোপ করা যাইতে পারে এবং সেজন্য কেহ লাইবেলের মকদ্দমা আনিবে না, তখন যে ব্যক্তি সভ্যতার কোনাে উপকরণ সম্বন্ধে প্রাচীন ভারতের দৈন্য স্বীকার করে সে পাষণ্ড, হৃদয়হীন, বিকৃতমস্তিষ্ক এবং স্বদেশদ্রোহী ! অতএব, তাহার কথার কোনাে মূল্য থাকিতে পারে না ; সে যে-সকল প্রমাণ আহরণ করে কোনাে প্রকৃত নিষ্ঠাবান ধর্মপ্রাণ হিন্দুসন্তান তাহাকে প্রমাণ বলিয়া গণ্য করিতেই পারেন না। এমন যুক্তি আমরা আরো অনেক দিতে পারি। কিন্তু আমরা হিন্দু, পৃথিবীতে আমাদের মতো উদার, আমাদের মতাে সহিষ্ণু জাতি আর নাই। আমরা পরের মতের উপর কোনাে হস্তক্ষেপ করিতে চাহি না। অতএব আমাদের সর্বপ্রধান যুক্তি বাপান্ত, অর্ধচন্দ্র এবং ধোপা-নাপিত-রোধ। > Q&br