পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্য ৬২১ করিতে চায়। অত্যন্ত দুরূহ কাজ। কারণ, মানবচরিত্র স্থির নহে সুসংগত নহে, তাহার অনেক অংশ, অনেক স্তর ; তাহার সদর-অন্দরে অবারিত গতিবিধি সহজ নয়। তা ছাড়া তাহার লীলা এত সূক্ষ্ম, এত অভাবনীয়, এত আকস্মিক যে, তাহাকে পূর্ণ আকারে আমাদের হৃদয়গম্য করা অসাধারণ ক্ষমতার : কাজ । ব্যাস-বাল্মীকি-কালিদাসগণ এই কাজ করিয়া আসিয়াছেন । এইবার আমাদের সমস্ত আলোচ্য বিষয়কে এক কথায় বলিতে গেলে এই বলিতে হয় সাহিত্যের বিষয় মানবহৃদয় এবং মানবচরিত্র । কিন্তু, মানবচরিত্র এটুকুও যেন বাহুল্য বলা হইল । বস্তুত বহিঃপ্রকৃতি এবং মানবচরিত্র মানুষের হৃদয়ের মধ্যে অনুক্ষণ যে আকার ধারণ করিতেছে, যে সংগীত ধ্বনিত করিয়া তুলিতেছে, ভাষােরচিত সেই চিত্র এবং সেই গানই সাহিত্য । . ভগবানের আনন্দ প্রকৃতির মধ্যে মানবচরিত্রের মধ্যে আপনাকে আপনি সৃষ্টি করিতেছে। মানুষের হৃদয়ও সাহিত্যে আপনাকে সৃজন করিবার, ব্যক্ত করিবার, চেষ্টা করিতেছে। এই চেষ্টার অন্ত নাই, ইহা বিচিত্র । কবিগণ মানবহৃদয়ের এই চিরন্তন চেষ্টার উপলক্ষমাত্র । ভগবানের আনন্দ সৃষ্টি আপনার মধ্য হইতে আপনি উৎসারিত ; মানবহৃদয়ের আনন্দ সৃষ্টি তাঁহারই প্রতিধ্বনি । এই জগৎসৃষ্টির আনন্দগীতের ঝংকার আমাদের হৃদয়বীণাতন্ত্রীকে অহরহ স্পন্দিত করিতেছে ; সেই-যে মানসসংগীত, ভগবানের সৃষ্টির প্রতিঘাতে আমাদের অন্তরের মধ্যে সেই- যে সৃষ্টির আবেগ, সাহিত্য তাঁহারই বিকাশ। বিশ্বের নিশ্বাস আমাদের চিত্তবংশীর মধ্যে কী রাগিণী বাজাইতেছে সাহিত্য তাহাই স্পষ্ট করিয়া প্ৰকাশ করিবার চেষ্টা করিতেছে । সাহিত্য ব্যক্তিবিশেষের নহে, তাহা রচয়িতার নহে, তাহা দৈববাণী । বহিঃসৃষ্টি যেমন তাহার ভালোমন্দ তাহার অসম্পূর্ণতা লইয়া চিরদিন ব্যক্ত হইবার চেষ্টা করিতেছে, এই বাণীও তেমনি দেশে দেশে, ভাষায় ভাষায়, আমাদের অগ্রহায়ণ ১৩১০ সাহিত্যের সামগ্ৰী একেবারে খাটিভাবে নিজের আনন্দের জন্যই লেখা সাহিত্য নহে । অনেকে কবিত্ব করিয়া বলেন যে, পাখি। যেমন নিজের উল্লাসেই গান করে, লেখকের রচনার উচ্ছােসও সেইরূপ আত্মগত, পাঠকেরা যেন তাহা আড়ি পাতিয়া শুনিয়া থাকেন । পাখির গানের মধ্যে পক্ষিসমাজের প্রতি যে কোনো লক্ষ নাই, এ কথা জোর করিয়া বলিতে পারি না । না থাকে তো নাই রহিল, তাহা লইয়া তর্ক করা বৃথা, কিন্তু লেখকের প্রধান লক্ষ্য পাঠকসমাজ । তা বলিয়াই যে সেটাকে কৃত্রিম বলিতে হইবে এমন কোনো কথা নাই। মাতার স্তন্য একমাত্র সন্তানের জন্য, তাই বলিয়াই তাহাকে স্বতঃস্ফূর্ত বলিবার কোনাে বাধা দেখি না। নীরব কবিত্ব এবং আত্মগত ভাবোচ্ছাস, সাহিত্যে এই দুটাে বাজে কথা কোনো কোনো মহলে চলিত আছে। যে কাঠ জ্বলে নাই তাঁহাকে আগুন নাম দেওয়াও যেমন, যে মানুষ আকাশের দিকে তাকাইয়া আকাশেরই মতো নীরব হইয়া থাকে তাহাকেও কবি বলা সেইরূপ । প্রকাশই কবিত্ব, মনের তলার মধ্যে কী আছে বা না আছে তাহা আলোচনা করিয়া বাহিরের লোকের কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি নাই । কথায় বলে 'মিষ্টান্নমিতরে জানাঃ ; ভাণ্ডারে কী জমা আছে তাহা আন্দাজে হিসাব করিয়া বাহিরের লোকের কোনো সুখ নাই, তাহাদের পক্ষে মিষ্টান্নটা হাতে হাতে পাওয়া আবশ্যক । সাহিত্যে আত্মগত ভাবোচ্ছােসও সেইরকমের একটা কথা । রচনা রচয়িতার নিজের জন্য নহে। ইহাই ধরিয়া লইতে হইবে, এবং সেইটে ধরিয়া লইয়াই বিচার করিতে হইবে । আমাদের মনের ভাবের একটা স্বাভাবিক প্রবৃত্তিই এই, সে নানা মনের মধ্যে নিজেকে অনুভূত