পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Vo S8 রবীন্দ্র-রচনাবলী শক্তি-অনুসারেই তাহা হৃদয়ে ও কালে ব্যাপ্তিলাভ করিতে পারে। প্ৰাণের জিনিস দেহের উপরে একান্ত নির্ভর করিয়া থাকে । জলের মতো তাহাকে এক পাত্ৰ হইতে আর-এক পাত্রে ঢালা যায় না । দেহ এবং প্ৰাণ পরস্পর পরস্পরকে গৌরবান্বিত করিয়া একাত্ম হইয়া বিরাজ করে । ভাব, বিষয়, তত্ত্ব সাধারণ মানুষের । তাহা একজন যদি বাহির না করে তো কালক্রমে আর-একজন বাহির করিবে । কিন্তু রচনা লেখকের সম্পূর্ণ নিজের । তাহা একজনের যেমন হইবে। আর-একজনের তেমন হইবে না | সেইজন্য রচনার মধ্যেই লেখক যথার্থরূপে বাচিয়া থাকে ; ভাবের মধ্যে নহে, বিষয়ের মধ্যে নহে । অবশ্য, রচনা বলিতে গেলে ভাবের সহিত ভাবপ্রকাশের উপায় দুই সম্মিলিতভাবে বুঝায় ; কিন্তু বিশেষ করিয়া উপায়টাই লেখকের । 赖 দিঘি বলিতে জল এবং খনন-করা আধার দুই একসঙ্গে বুঝায়। কিন্তু কীর্তি কোনটা ? জল মানুষের সৃষ্টি নহে— তাহা চিরন্তন । সেই জলকে বিশেষভাবে সর্বসাধারণের ভোগের জন্য সুদীর্ঘকাল রক্ষা করিবার যে উপায় তাহাই কীর্তিমান মানুষের নিজের ৷ ভাব সেইরূপ মনুষ্যসাধারণের, কিন্তু তাহাকে বিশেষ মূর্তিতে সর্বলোকের বিশেষ আনন্দের সামগ্ৰী করিয়া তুলিবার উপায়-রচনাই লেখকের কীর্তি । অতএব দেখিতেছি, ভাবকে নিজের করিয়া সকলের করা ইহাই সাহিত্য, ইহাই ললিতকলা । অঙ্গার-জিনিসটা জলে স্থলে বাতাসে নানা পদার্থে সাধারণভাবে সাধারণের আছে ; গাছপালা তাহাকে নিগুঢ় শক্তিবলে বিশেষ আকারে প্রথমত নিজের করিয়া লয়, এবং সেই উপায়েই তাহা সুদীর্ঘকাল বিশেষভাবে সর্বসাধারণের ভোগের দ্রব্য হইয়া উঠে। শুধু যে তাহা আহার এবং উত্তাপের কাজে লাগে তাহা নহে ; তাহা হইতে সৌন্দর্য, ছায়া, স্বাস্থ্য বিকীর্ণ হইতে থাকে । অতএব দেখা যাইতেছে, সাধারণের জিনিসকে বিশেষভাবে নিজের করিয়া সেই উপায়েই তাহাকে পুনশ্চ বিশেষভাবে সাধারণের করিয়া তোলা সাহিত্যের কাজ । তা যদি হয় তবে জ্ঞানের জিনিস সাহিত্য হইতে আপনি বাদ পড়িয়া যায় । কারণ, ইংরেজিতে যাহাকে টুথ বলে এবং বাংলাতে যাহাকে আমরা সত্য নাম দিয়াছি অর্থাৎ যাহা আমাদের বুদ্ধির অধিগম্য বিষয়, তাহাকে ব্যক্তিবিশেষের নিজত্ববর্জিত করিয়া তোলাই একান্ত দরকার | সত্য সর্বাংশেই ব্যক্তিনিরপেক্ষ, শুভ্ৰনিরঞ্জন | মাধ্যাকৰ্ষণতত্ত্ব আমার কাছে একরূপ, অন্যের কাছে অন্যরূপ নহে । তাহার উপরে বিচিত্র হৃদয়ের নূতন নূতন রঙের ছায়া পড়িবার জো নাই । যে-সকল জিনিস অন্যের হৃদয়ে সঞ্চারিত হইবার জন্য প্রতিভাশালী হৃদয়ের কাছে সুর রঙ ইঙ্গিত প্রার্থনা করে, যাহা আমাদের হৃদয়ের দ্বারা সৃষ্ট না হইয়া উঠিলে অন্য হৃদয়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠালাভ করিতে পারে না, তাহাই সাহিত্যের সামগ্ৰী । তাহা আকারে প্রকারে, ভাবে ভাষায়, সুরে ছন্দে মিলিয়া। তবেই বঁচিতে পারে ; তাহা মানুষের একান্ত আপনার ; তাহা আবিষ্কার নহে, অনুকরণ নহে, তাহা সৃষ্টি । সুতরাং ত্যাহা একবার প্রকাশিত হইয়া উঠিলে তাহার রূপান্তর অবস্থান্তর করা চলে না ; তাহার প্রত্যেক ংশের উপরে তাহার সমগ্রতা একান্তভাবে নির্ভর করে । যেখানে তাহার ব্যত্যয় দেখা যায় সেখানে সাহিত্য-অংশে তাহা হেয় । সাহিত্যের বিচারক ঘরে বসিয়া আনন্দে যখন হাসি এবং দুঃখে যখন কাদি তখন এ কথা কখনো মনে উদয় হয় না যে, আরো একটু বেশি করিয়া হাসা দরকার বা কান্নাটা ওজনে কম পড়িয়াছে। কিন্তু পরের কাছে যখন আনন্দ বা দুঃখ দেখানো আবশ্যক হইয়া পড়ে তখন মনের ভাবটা সত্য হইলেও বাহিরের প্রকাশটা সম্পূর্ণ তাহার অনুযায়ী না হইতে পারে।