পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৬২৮ - রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী মনুষ্যসমাজই তীহাদের লক্ষ্য । যাহা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কালের জন্য লিখিত তাহার অধিকাংশ সাক্ষী ও বিচারক বর্তমান কাল হইতে কেমন করিয়া মিলিবে ? ইহা প্রায়ই দেখা যায় যে, যাহা তৎসাময়িক ও তৎস্থানিক তাহাই অধিকাংশ লোকের কাছে সর্বপ্রধান আসন অধিকার করে। কোনো-একটি বিশেষ সময়ের সাক্ষী-সংখ্যা গণনা করিয়া সাহিত্যের বিচার করিতে গেলে অবিচার হইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা আছে। এইজন্য বর্তমান কালকে অতিক্রম করিয়া সর্বকালের দিকেই সাহিত্যকে লক্ষানিবেশ করিতে হয় । কালে কালে মানুষের বিচিত্র শিক্ষা ভাব ও অবস্থার পরিবর্তন-সত্ত্বেও যে-সকল রচনা আপন মহিমা রক্ষা করিয়া চলিয়াছে তাহাদেরই অগ্নিপরীক্ষা হইয়া গেছে | মন আমাদের সহজগোচর নয় এবং অল্প সময়ের মধ্যে আবদ্ধ করিয়া দেখিলে অবিশ্রাম গতির মধ্যে তাহার নিত্যানিত্য সংগ্ৰহ করিয়া লওয়া আমাদের পক্ষে দুঃসাধ্য হয় । এইজন্য সুবিপুল কালের পরিদর্শনশালার মধ্যেই মানুষের মানসিক বস্তুর পরীক্ষা করিয়া দেখিতে হয় ; ইহা ছাড়া নিশ্চয় অবধারণের চূড়ান্ত উপায় নাই। কিন্তু কাজ চলিবার মতো উপায় না থাকিলে সাহিত্যে অরাজকতা উপস্থিত হইত। হাইকোর্টের আপিল-আদালতে যে জজ-আদালতের সমস্ত বিচারই পর্যস্ত হইয়া যায় তাহা নহে | সাহিত্যেও সেইরূপ জজ-আদালতের কাজ বন্ধ থাকিতে পারে না । আপিলের শেষ মীমাংসা অতিদীর্ঘকালসাপেক্ষ । ততক্ষণ মোটামুটি বিচার একরকম পাওয়া যায় এবং অবিচার পাইলেও উপায় নাই । যেমন সাহিত্যের স্বাধীন রচনায় এক-একজনের প্রতিভা সর্বকালের প্রতিনিধিত্ব গ্ৰহণ করে, সর্বকালের আসন অধিকার করে, তেমনি বিচারের প্রতিভাও আছে ; এক-একজনের পরখ করিবার শক্তিও স্বভাবতই অসামান্য হইয়া থাকে । যাহা ক্ষণিক, যাহা সংকীর্ণ, তাহা তাহাদিগকে ফাকি দিতে পারে না ; যাহা ধ্রুব, যাহা চিরন্তন, এক মুহুর্তেই তাহা তাহারা চিনিতে পারেন । সাহিত্যের নিত্যবস্তুর সহিত পরিচয়লাভ করিয়া নিত্যত্বের লক্ষণগুলি তাহারা জ্ঞাতসারে এবং অলক্ষ্যে অন্তঃকরণের সহিত মিলাইয়া লইয়াছেন ; স্বভাবে এবং শিক্ষায় তাহারা সর্বকালীন বিচারকের পদ গ্রহণ করিবার যোগ্য । আবার ব্যাবসাদার বিচারকও আছে। তাহাদের পুঁথিগত বিদ্যা। তাহারা সারস্বতপ্রাসাদের দেউড়িতে বসিয়া হাঁকড়াক, তৰ্জানগর্জন, ঘুষ ও ঘুষির কারবার করিয়া থাকে ; অন্তঃপুরের সহিত তাহাদের পরিচয় নাই। তাহারা অনেক সময়েই গাড়িজুড়ি ও ঘড়ির চেন দেখিয়াই ভোলে। কিন্তু বীণাপাণির অনেক অন্তঃপুরচারী আত্মীয় বিরলবেশে দীনের মতো মা'র কাছে যায় এবং তিনি তাহাদিগকে কোলে লইয়া মস্তকাত্মাণ করেন। তাহারা কখনো-কখনো তাহার শুভ্ৰ অঞ্চলে কিছু-কিছু ধূলিক্ষেপও করে ; তিনি তাহা হাসিয়া ঝাড়িয়া ফেলেন। এই সমস্ত ধূলামাটি সত্ত্বেও দেবী যাহাদিগকে আপনার বলিয়া কোলে তুলিয়া লন দেউড়ির দরোয়ানগুলা তাহাদিগকে চিনিবে কোন লক্ষণ দেখিয়া ? তাহারা পোশাক চেনে, তাহারা মানুষ চেনে না। তাহারা উৎপাত করিতে পারে, কিন্তু বিচার করিবার ভার তাহাদের উপর নাই। সারস্বতদিগকে অভ্যর্থনা করিয়া লইবার ভার র্যাহাদের উপরে আছে র্তাহারাও নিজে সরস্বতীর সন্তান ; তঁাহারা ঘরের লোক, ঘরের লোকের মর্যাদা বোঝেন । আশ্বিন ১৩১০ সৌন্দর্যবোধ প্রথম-বয়সে ব্ৰহ্মচর্যপালন করিয়া নিয়মে সংযমে জীবনকে গড়িয়া তুলিতে হইবে, ভারতবর্ষের এই প্রাচীন উপদেশের কথা তুলিতে গেলে অনেকের মনে এই তর্ক উঠবে, এ যে বড়ো কঠোর সাধনা | ইহার দ্বারা নাহয় খুব একটা শক্ত মানুষ তৈরি করিয়া তুলিলে, নাহয় বাসনার দড়িদড় ছিড়িয়া মস্ত একজন সাধুপুরুষ হইয়া উঠিলে, কিন্তু এ সাধনায় রসের স্থান কোথায় ? কোথায় গেল সাহিত্য, চিত্র, সংগীত ? মানুষকে যদি পুরা করিয়া তুলিতে হয় তবে সৌন্দর্যচর্চাকে ফাকি দেওয়া চলে না।