পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৩৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্য Ved সৌন্দর্য যেমন আমাদিগকে ক্ৰমে ক্ৰমে শোভনতার দিকে, সংযমের দিকে, আকর্ষণ করিয়া আনিতেছে। সংযমও তেমনি আমাদের সৌন্দর্যভোগের গভীরতা বাড়াইয়া দিতেছে। স্তৰূভাবে নিবিষ্ট হইতে না জানিলে আমরা সৌন্দর্যের মর্মস্থান হইতে রস উদ্ধার করিতে পারি না। একপরায়ণা সতী স্ত্রীই তো প্রেমের যথার্থ সৌন্দর্য উপলব্ধি করিতে পারে, স্বৈরিণী তো পারে না। সতীত্ব সেই চাঞ্চল্যবিহীন সংযম যাহার দ্বারা গভীরভাবে প্রেমের নিগুঢ় রস লাভ করা সম্ভব হয়। আমাদের সৌন্দর্যপ্রিয়তার মধ্যেও যদি সেই সতীত্বের সংযম না থাকে। তবে কী হয় ? সে কেবলই সৌন্দর্যের বাহিরে বাহিরে চঞ্চল হইয়া ঘুরিয়া বেড়ায় ; মত্ততাকেই আনন্দ বলিয়া ভুল করে ; যাহাকে পাইলে সে একেবীরে সব ছাড়িয়া স্থির হইয়া বসিতে পারিত তাহাকে পায় না। যথার্থ সৌন্দর্য সমাহিত সাধকের কাছেই প্রত্যক্ষ, লোলুপ ভোগীর কাছে নহে। যে লোক পেটুক সে ভোজনের রসজ্ঞা হইতে পারে না। পৌষ্যরাজা ঋষিকুমার। উতঙ্ককে কহিলেন, যাও, অন্তঃপুরে যাও, সেখানে মহিষীকে দেখিতে পাইবে । উতঙ্ক অন্তঃপুরে গেলেন, কিন্তু মহিষীকে দেখিতে পাইলেন না। অশুচি হইয়া কেহ সতীকে দেখিতে পাইত না ; উতঙ্ক তখন অশুচি ছিলেন । । বিশ্বের সমস্ত সৌন্দর্যের সমস্ত মহিমার অন্তঃপুরে যে সতীলক্ষ্মী বিরাজ করিতেছেন তিনিও আমাদের সম্মুখেই আছেন, কিন্তু শুচি না হইলে দেখিতে পাইব না। যখন বিলাসে হাবুডুবু খাই, ভোগের নেশায় মাতিয়া বেড়াই, তখন বিশ্বজগতের আলোকবসনা সতীলক্ষ্মী আমাদের দৃষ্টি হইতে অন্তর্ধান করেন । - এ কথা ধর্মনীতিপ্রচারের দিক হইতে বলিতেছি না ; আনন্দের দিক হইতে যাহাকে ইংরেজিতে আর্ট বলে, তাহারই তরফ হইতে বলিতেছি। আমাদের শাস্ত্রেও বলে, কেবল ধর্মের জন্য নয়, সুখের জন্যও সংযত হইবে । সুখাৰ্থ সংযতো ভবেৎ। অর্থাৎ ইচ্ছার যদি চরিতার্থতা চাও তবে ইচ্ছাকে শাসনে রাখো, যদি সৌন্দর্যভোগ করিতে চাও তবে ভোগলালসাকে দমন করিয়া শুচি হইয়া শান্ত হও । প্রবৃত্তিকে যদি দমন করিতে না জানি তবে প্রবৃত্তিরই চরিতার্থতাকে আমরা সৌন্দর্যবােধের চরিতার্থতা বলিয়া ভুল করি, যাহা চিত্তের জিনিস তাহাকে দুই হাতে করিয়া দলিয়া মনে করি যেন তাহাকে পাইলাম। এইজন্যই বলিয়াছি, সৌন্দর্যবােধ ঠিকমত-উদবােধনের জন্য ব্ৰহ্মচর্যের সাধনই আবশ্যক। যাহাদের চােখে ধূলা দেওয়া শক্ত র্তাহারা হঠাৎ সন্ধিগ্ধ হইয়া বলিয়া উঠিবেন, এ যে একেবারে কবিত্ব আসিয়া পড়িল। তাহারা বলবেন, সংসারে তাে আমরা প্রায়ই দেখিতে পাই, যে-সকল কলাকুশল গুণী সৌন্দর্যসৃষ্টি করিয়া আসিয়াছেন তাহারা অনেকেই সংযমের দৃষ্টান্ত রাখিয়া যান নাই। তাহাদের জীবনচরিতটা পাঠ্য নহে। অতএব কবিত্ব রাখিয়া এই বাস্তব সত্যটার আলোচনা করা দরকার । আমার বক্তব্য এই যে, বাস্তবকে আমরা এত বেশি বিশ্বাস করি কেন ? কারণ, সে প্রত্যক্ষগোচর । কিন্তু অনেক স্থলেই মানুষের সম্বন্ধে আমরা যাহাকে বাস্তব বলি তাহার বেশির ভাগই আমাদের অপ্রত্যক্ষ । একটুখানি দেখিতে পাই বলিয়া মনে করি সবটাই যেন দেখিতে পাইলাম, এইজন্য মানুষ-ঘটিত বাস্তব বৃত্তান্ত লইয়া একজন যাহাকে সাদা বলে আর-একজন তাহাকে মোট বলিলেও বাচিতাম, তাহাকে একেবারে কালো বলিয়া বসে। নেপোলিয়নকে কেহ বলে দেবতা, কেহ বলে দানব। আকবরকে কেহ বলে উদার প্রজাহিতৈষী, কেহ বলে তঁহার হিন্দুপ্ৰজার পক্ষে তিনিই যত নষ্টের গোড়া। কেহ বলেন বর্ণভেদেই আমাদের হিন্দুসমাজ রক্ষা করিয়াছে, কেহ বলে বর্ণভেদের প্ৰথাই আমাদিগকে একেবারে মাটি করিয়া দিল । অথচ উভয় পক্ষেই বাস্তব সত্যের দোহাই দেয়। বস্তুত মানুষ-ঘটিত ব্যাপারে একই জায়গায় আমরা অনেক উলটা কাণ্ড দেখিতে পাই। মানুষের দেখা-অংশের মধ্যে যে-সকল বৈপরীত্য প্রকাশ পায় মানুষের না-দেখা অংশের মধ্যেই নিশ্চয় তাহার একটা নিগুঢ় সমন্বয় আছে; অতএব আসল সত্যটা যে প্রত্যক্ষের উপরেই ভাসিয়া বেড়াইতেছে তাহা নহে, অপ্রত্যক্ষের মধ্যেই ডুবিয়া আছে; এইজনাই তাহাকে লইয়া এত তর্ক, এত দলাদলি এবং এইজন্যই একই ইতিহাসকে দুই বিরুদ্ধ পক্ষে ওকালতনামা দিয়া থাকে।