পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\ტ8\ტ রবীন্দ্র-রচনাবলী কুলায় না সেই সকল রসের বন্যাই সাহিত্যের মধ্যে ঢেউ তুলিয়া কলধ্বনি করিতে করিতে বহিয়া যায়। মানুষ তাহাকে কাজের মধ্যেই নিঃশেষ করিয়া দিতে পারে না বলিয়াই ভরা হৃদয়ের বেগে সাহিত্যের মধ্যে তাহাকে প্রকাশ করিয়া। তবে বঁাচে | এইরূপ প্রাচুর্যেই মানুষের যথার্থ প্রকাশ । মানুষ যে ভোজনপ্রিয় তাহা সত্য বটে, কিন্তু মানুষ যে বীর ইহাই সত্যতম। মানুষের এই সত্যের জোর সামলাইবে কে ? তাহা ভাগীরথীর মতো পাথর গুড়াইয়া, ঐরাবতীকে ভাসাইয়া, গ্রাম নগর শস্যক্ষেত্রের তৃষ্ণা মিটাইয়া, একেবারে সমুদ্রে গিয়া পড়িয়ছে। মানুষের বীরত্ব মানুষের সংসারের সমস্ত কােজ সারিয়া দিয়া সংসারকে ছাপাইয়া উঠিয়াছে। এমনি করিয়া স্বভাবতই মানুষের যাহা-কিছু বড়ো, যাহা-কিছু নিত্য, যাহা সে কাজে-কর্মে ফুরাইয়া ফেলিতে পারে না, তাহাই মানুষের সাহিত্যে ধরা পড়িয়া আপনা-আপনি মানুষের বিরাটরূপকেই গড়িয়া তুলে। আরো একটি কারণ আছে। সংসারে যাহাকে আমরা দেখি তাহাকে ছড়াইয়া দেখি ; তাহাকে এখন একটু তখন একটু, এখানে একটু সেখানে একটু দেখি ; তাহাকে আরো দশটার সঙ্গে মিশাইয়া দেখি । কিন্তু সাহিত্যে সেই-সকল ফাক, সেই-সকল মিশাল থাকে না । সেখানে যাহাকে প্রকাশ করা হয় তাহার উপরেই সমস্ত আলো ফেলা হয়। তখনকার মতো আর-কিছুকেই দেখিতে দেওয়া হয় না। তাহার জন্য নানা কৌশলে এমন একটি স্থান তৈরি করিয়া দেওয়া হয় যেখানে সেই কেবল দীপ্যমান । এমন অবস্থায়, এমন জমাট স্বাতন্ত্র্যে, এমন প্রখর আলোকে যাহাকে মানাইবে না। তাহাকে আমরা স্বভাবতই এ জায়গায় দাড় করাই না । কারণ, এমন স্থানে অযোগ্যকে দাড় করাইলে তাহাকে লজ্জিত করা হয় । সংসারের নানা আচ্ছাদনের মধ্যে পেটুক তেমন করিয়া চোখে পড়ে না, কিন্তু সাহিত্যমঞ্চের উপর তাহাকে একাগ্র আলোকে ধরিয়া দেখাইলে সে হাস্যকর হইয়া উঠে । এইজন্য মানুষের যে-প্রকাশটি তুচ্ছ নয়, মানবহৃদয় যাহাকে করুণায় বা বীৰ্যে, রুদ্রতায় বা শান্তিতে আপনার উপযুক্ত প্রতিনিধি বলিয়া স্বীকার করিতে কুষ্ঠিত না হয়, যাহা কলানৈপুণ্যের বেষ্টনীর মধ্যে দাড়াইয়া নিত্যকালের অনিমেষ দৃষ্টিপাত মাথা তুলিয়া সহা করিতে পারে, স্বভাবতই মানুষ তাহাকেই সাহিতে্যু স্থান দেয় ; নহলে তাহার অসংগতি আমাদের কাছে পীড়াজনক হইয়া উঠে । রাজা ছাড়া আর-কাহাকেও সিংহাসনের উপর দেখিলে আমাদের মনে বিদ্রোহ উপস্থিত হয় । কিন্তু সকল মানুষের বিচারবুদ্ধি বড়ো নয়, সকল সমােজও বড়ো নয়, এবং এক-একটা সময় আসে যখন ক্ষণিক ও ক্ষুদ্র মোহে মানুষকে ছোটাে করিয়া দেয়। তখন সেই দুঃসময়ের বিকৃত দর্পণে ছোটাে জিনিস বড়ো হইয়া দেখা দেয় এবং তখনকার সাহিত্যে মানুষ আপনার ছোটােকেই বড়ো করিয়া তোলে, আপনার কলঙ্কের উপরেই স্পর্ধার সঙ্গে আলো ফেলে। তখন কলার বদলে কৌশল, গৌরবের জায়গায় গর্ব এবং টেনিসনের আসনে কিপলিঙের আবির্ভাব হয়। কিন্তু মহাকাল বসিয়া আছেন । তিনি তো সমস্তই ছাকিয়া লইবেন । তাহার চালুনির মধ্য দিয়া যাহা ছোটাে, যাহা জীর্ণ তাহা গলিয়া ধুলায় পড়িয়া ধুলা হইয়া যায়। নানা কাল ও নানা লোকের হাতে সেই-সকল জিনিসই টেকে যাহার মধ্যে সকল মানুষই আপনাকে দেখিতে পায় । এমনি করিয়া বাছাই হইয়া যাহা থাকিয়া যায় তাহা মানুষের সর্বদেশের সর্বকালের ধন । এমনি করিয়া ভাঙিয়া গড়িয়া সাহিত্যের মধ্যে মানুষের প্রকৃতির, মানুষের প্রকাশের একটি নিত্যকালীন আদর্শ আপনি সঞ্চিত হইয়া উঠিতেছে। সেই আদর্শই নূতন যুগের সাহিত্যেরও হাল ধরিয়া থাকে। সেই আদর্শমতই যদি আমরা সাহিত্যের বিচার করি তবে সমগ্ৰ মানবের বিচারবুদ্ধির नाशया क्ल&ग्र श । এইবার আমার আসল কথাটি বলিবার সময় উপস্থিত হইয়াছে ; সেটি এই, সাহিত্যকে দেশকালপত্রে ছোটাে করিয়া দেখিলে ঠিকমত দেখাই হয় না। আমরা যদি এইটে বুঝি যে, সাহিত্যে বিশ্বমানবই আপনাকে প্ৰকাশ করিতেছে তবে সাহিত্যের মধ্যে আমাদের যাহা দেখিবার তাহা দেখিতে পাইব । যেখানে সাহিত্যরচনায় লেখক উপলক্ষমাত্র না হইয়াছে সেখানে তাহার লেখা নষ্ট হইয়া