পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VbG NR রবীন্দ্র-রচনাবলী খাটিতেছে, অধিকাংশকেই আমরা ব্যবহারে লাগাইতে পারি নাই। তা হউক, তবু আমাদের জ্ঞান সেই জানা জগৎ ও না-জানা জগতের দ্বন্দ্ব প্রতিদিন একটু একটু ঘুচাইয়া চলিয়াছে; যুক্তিজাল বিস্তার করিয়া জগতের সমস্ত সত্যকে ক্ৰমে আমাদের বুদ্ধির অধিকারে আনিতেছে ও জগৎকে আমাদের মনের জগৎ, আমাদের জ্ঞানের জগৎ, করিয়া তুলিতেছে। আমাদের কর্মশক্তি জগতের সমস্ত শক্তিকে ব্যবহারের দ্বারা ক্রমে ক্রমে আপন করিয়া তুলিতেছে এবং বিদ্যুৎ জল অগ্নি বাতাস দিনে দিনে আমাদেরই বৃহৎ কৰ্মশরীর হইয়া উঠিতেছে। আমাদের সৌন্দর্যবোধও ক্রমে ক্রমে সমস্ত জগৎকে আমাদের আনন্দের জগৎ করিয়া তুলিতেছে ; সেই দিকেই তাহার গতি । জ্ঞানের দ্বারা সমস্ত জগতে আমার মন ব্যাপ্ত হইবে, কর্মের দ্বারা সমস্ত জগতে আমার শক্তি ব্যাপ্ত হইবে, এবং সৌন্দর্যেবোধের দ্বারা সমস্ত জগতে আমার আনন্দ ব্যাপ্ত হইবে, মনুষ্যত্বের ইহাই লক্ষ্য। অর্থাৎ জগৎকে জ্ঞানরূপে পাওয়া, শক্তিরূপে পাওয়া ও আনন্দরূপে পাওয়াকেই মানুষ হওয়া বলে। কিন্তু পাওয়া না-পাওয়ার বিরোধের ভিতর দিয়া ছাড়া, পাওয়া যাইতেই পারে না ; দ্বন্দ্বের ভিতর দিয়া ছাড়া বিকাশ হইতেই পারে না— সৃষ্টির গোড়াকার এই নিয়ম। একের দুই হওয়া এবং দুয়ের এক হইতে থাকাই বিকাশ । বিজ্ঞানের দিক দিয়া দেখো । মানুষের একদিন এমন অবস্থা ছিল যখন সে গাছে পাথরে মানুষে মেঘে চন্দ্রে সূর্যে নদীতে পর্বতে প্ৰাণী-অপ্রাণীর ভেদ দেখিতে পাইত না । তখন সবই তাহার কাছে যেন সমানধর্মাবলম্বী ছিল । ক্রমে তাহার বৈজ্ঞানিক-বুদ্ধিতে প্ৰাণী ও অপ্রাণীর ভেদ একান্ত হইয়া উঠিতে লাগিল । এইরূপে অভেদ হইতে প্ৰথমে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হইল । তাহা যদি না হইত, তবে প্ৰাণের প্রকৃত লক্ষণগুলিকে সে কোনোদিন জানিতেই পারিত না । এ দিকে লক্ষণগুলিকে যতই সে সত্যু করিয়া জানিতে লাগিল দ্বন্দ্ব ততই দূরে সরিয়া যাইতে থাকিল। প্রথমে প্রাণী ও উদ্ভিদের মাঝখানের গণ্ডিটা ঝাপসা হইয়া আসিল ; কোথায় উদ্ভিদের শেষ ও প্রাণীর আরম্ভ তাহা আর ঠাহর করা যায় না । তাহার পরে আজ ধাতুদ্রব্য, যাহাকে জড় বলিয়া নিশ্চিন্ত আছি, তাহার মধ্যেও প্রাণের লক্ষণ বিজ্ঞানের চক্ষে ধরা দিবার উপক্ৰম করিতেছে। অতএব যে ভেদবুদ্ধির সাহায্যে আমরা প্ৰাণ জিনিসটাকে চিনিয়াছি, চেনার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গেই সেই ভেদটা ক্রমেই লুপ্ত হইতে থাকিবে, অভেদ হইতে দ্বন্দু এবং দ্বন্দ্ব হইতেই ঐক্য বাহির হইবে এবং অবশেষে বিজ্ঞান একদিন উপনিষদের ঋষিদের সঙ্গে সমান সুরে বলিবে ; সর্বং প্রাণ এজাতি । সমস্তই প্ৰাণে কম্পিত হইতেছে। যেমন সমস্তই প্ৰাণে কঁাপিতেছে তেমনি সমস্তই আনন্দ, উপনিষদ এ কথাও বলিয়াছেন । জগতের এই নিরবচ্ছিন্ন আনন্দরূপ দেখিবার পথে সুন্দর-অসুন্দরের ভেদটা প্ৰথমে একান্ত হইয়া মাথা তোলে । নহিলে সুন্দরের পরিচয় ঘটা একেবারে অসম্ভব । আমাদের সৌন্দর্যবোধের প্রথমাবস্থায় সৌন্দর্যের একান্ত স্বাতন্ত্র্য আমাদিগকে যেন ঘা মারিয়া জাগাইতে চায়। এইজন্য বৈপরীত্য তাহার প্রথম অস্ত্র। খুব একটা টকটকে রঙ, খুব একটা গঠনের বৈচিত্র্য, নিজের চারিদিকের স্নানতা হইতে যেন ফুড়িয়া উঠিয়া আমাদিগকে হাক দিয়া ডাকে । সংগীত সৌন্দর্যবোধ যতই বিকাশ পায় ততই স্বাতন্ত্র্য নহে, সুসংগতি— আঘাত নহে, আকর্ষণ— আধিপত্য নহে, সামঞ্জস্য, আমাদিগকে আনন্দ দান করে । এইরূপে সৌন্দর্যকে প্রথমে চারি দিক হইতে স্বতন্ত্র একটুখানির মধ্যে দেখিলে আমরা অনিয়ম দেখি, চারি দিকের সঙ্গে অখণ্ড করিয়া মিলাইয়া দেখিলেই নিয়ম আমাদের কাছে ধরা পড়ে ; তখন যদিচ ধোয়া আকাশে উড়িয়া যায় ও ঢেলা মাটিতে পড়ে, সোলা জলে ভাসে ও লোহা জলে ডোবে, তবু এই সমস্ত দ্বৈতের মধ্যে ভারাকর্ষণের এক নিয়মের কোথাও বিচ্ছেদ দেখি না । জ্ঞানকে ভ্ৰমমুক্ত করিবার এই যেমন উপায় তেমনি আনন্দকেও বিশুদ্ধ করিতে হইলে তাঁহাকে