পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V(8 রবীন্দ্র-রচনাবলী জাপানিদের সাহস যুদ্ধে জয়ী হইয়াছে। সাহিত্যে মানুষ বৃহৎভাবে আত্মপ্রকাশ করিতেছে, সে ক্রমশই তাহার আনন্দকে খণ্ড হইতে অখণ্ডের দিকে অগ্রসর করিয়া ব্যক্তি করিতেছে- বড়ো করিয়া দেখিলে এ কথা সত্য ; বিকৃতি এবং ত্রুটি যতই থাক, তবু সব লইয়াই এ কথা সত্য। একটি কথা আমাদিগের মনে রাখিতে হইবে, সাহিত্য দুই রকম করিয়া আমাদিগকে আনন্দ দেয়। এক, সে সত্যকে মনোহররূপে আমাদিগকে দেখায়, আর, সে সত্যকে আমাদের গোচর করিয়া দেয় । সত্যকে গোচর করানাে বড়ো শক্ত কাজ । হিমালয়ের শিখর কত হাজার ফিট উচু, তাহার মাথায় কতখানি বরফ আছে, তাহার কোন অংশে কোন শ্রেণীর উদ্ভিদ জন্মে, তাহা তন্ন তন্ন করিয়া বলিলেও হিমালয় আমাদের গোচর হয় না । যিনি কয়েকটি কথায় এই হিমালয়কে আমাদের গোচর করিয়া দিতে পারেন তাহাকে আমরা কবি বলি। হিমালয় কেন, একটা পানাপুকুরকেও আমাদের মনশ্চক্ষুর সামনে ধরিয়া দিলে আমাদের আনন্দ হয়। পানাপুকুরকে চােখে আমরা অনেক দেখিয়াছি, কিন্তু তাহাকেই ভাষার ভিতর দিয়া দেখিলে তাহাকে নূতন করিয়া দেখা হয় ; মন চক্ষুরিন্দ্ৰিয় দিয়া যেটাকে দেখিতে পায় ভাষা যদি ইন্দ্ৰিয়স্বরূপ হইয়া সেইটােকেই দেখাইতে পারে তবে মন তাহাতে নূতন একটা রস লাভ করে । এইরূপে সাহিতা আমাদের নূতন একটি ইন্দ্ৰিয়ের মতো হইয়া জগৎকে আমাদের কাছে নূতন করিয়া দেখায় । কেবল নূতন নয়। ভাষার একটা বিশেষত্ব আছে, সে মানুষের নিজের জিনিস, সে অনেকটা আমাদের মন-গড়া ; এইজন্য বাহিরের যে-কোনো জিনিসকে সে আমাদের কাছে আনিয়া দেয় সেটাকে যেন বিশেষ করিয়া মানুষের জিনিস করিয়া তোলে। ভাষা যে ছবি আঁকে সে ছবি যে যথাযথ ছবি বলিয়া আমাদের কাছে আদর পায় তাহা নহে ; ভাষা যেন তাহার মধ্যে একটা মানবরাস মিশাইয়া দেয়, এইজন্য সে ছবি আমাদের হৃদয়ের কাছে একটা বিশেষ আত্মীয়তা লাভ করে। বিশ্বজগৎকে ভাষা দিয়া মানুষের ভিতর দিয়া চােলাইয়া লইলে সে আমাদের অত্যন্ত কাছে আসিয়া পড়ে । শুধু তাই নয়, ভাষার মধ্য দিয়া যে ছবি আমাদের কাছে আসে সে সমস্ত খুঁটিনাটি লইয়া আসে না । সে কেবল ততটুকুই আসে যতটুকুতে সে একটি বিশেষ সমগ্ৰতা লাভ করে। এইজন্য তাহাকে একটি অখণ্ডরসের সঙ্গে দেখিতে পাই ; কোনো অনাবশ্যক বাহুল্য সেই রস ভঙ্গ করে না। সেই সুসম্পূর্ণ দুঃভিতর দিয়া দেখাতেই সে বি আমাদের অন্তকরণের কাছে এত অক্তি করা গােচর হয় কবিকঙ্কণচণ্ডীতে ভাড়দত্তের যে বর্ণনা আছে সে বর্ণনায় মানুষের চরিত্রের যে একটা বড়ো দিক দেখানো হইয়াছে তাহা নহে, এইরকম চতুর স্বার্থপর এবং গায়ে পড়িয়া মোড়লি করিতে মজবুত লোক আমরা অনেক দেখিয়াছি। তাহাদের সঙ্গ যে সুখকর তাহাও বলিতে পারি না । কিন্তু কবিকঙ্কণ এই ছাদের মানুষটিকে আমাদের কাছে যে মূর্তিমান করিতে পারিয়াছেন তাহার একটি বিশেষ কারণ আছে। ভাষায় এমন একটু কৌতুকরস লইয়া সে জাগিয়া উঠিয়াছে যে, সে শুধু কালকেতুর সভায় নয়, আমাদেরও হৃদয়ের দরবারে অনায়াসে স্থান পাইয়াছে। ভাড়দত্ত প্রত্যক্ষসংসারে ঠিক এমন করিয়া আমাদের গোচর হইত না। আমাদের মনের কাছে সুসহ করিবার পক্ষে ভাড়দত্তের যতটুকু আবশ্যক কবি তাহার চেয়ে বেশি কিছুই দেন নাই । কিন্তু প্রত্যক্ষসংসারের ভাড়দত্ত ঠিক ঐটুকুমাত্র নয় ; এইজন্যই সে আমাদের কাছে অমন করিয়া গোচর হইবার অবকাশ পায় না । কোনো-একটা সমগ্রভাবে সে আমাদের কাছে গোচর হয় না বলিয়াই আমরা তাহাতে আনন্দ পাই না | কবিকঙ্কণ-চণ্ডীতে ভাড়দত্ত তাহার সমস্ত অনাবশ্যক বাহুল্য বর্জন করিয়া কেবল একটি সমগ্ররসের মূর্তিতে আমাদের কাছে প্রকাশ পাইয়াছে। ভঁড়দত্ত যেমন, চরিত্ৰমাত্রই সেইরূপ। রামায়ণের রাম যে কেবল মহান বলিয়াই আমাদিগকে আনন্দ দিতেছেন তাহা নহে, তিনি আমাদের সুগোচর, সেও একটা কারণ। রামকে যেটুকু দেখিলে একটি সমগ্ররসে তিনি আমাদের কাছে জাগিয়া উঠেন, সমস্ত বিক্ষিপ্ততা বাদ দিয়া রামায়ণ কেবল সেইটুকুই আমাদের কাছে আনিয়াছে ; এইজন্য এত স্পষ্ট তাহাকে দেখিতে পাইতেছি, এবং স্পষ্ট