পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্য \s একটা ভাবের সৃষ্টি চলিতেছে তাহার স্থিতিগতির ক্ষেত্র অতি বৃহৎ । তাহা দেখিতে আকস্মিক ; এই ৷ চৈত্রমাসে যে ঘন ঘন এত বৃষ্টি হইয়া গেল সেও তাে আকস্মিক বলিয়া মনে হয়। কিন্তু কত সুদূর পশ্চিম হইতে কারণ পরম্পরার দ্বারা বাহিত হইয়া, কোথাও বা বিশেষ সুযোগ কোথাও বা বিশেষ বাধা পাইয়া, সেই বৃষ্টি আমার ক্ষেত্ৰকে অভিষিক্ত করিয়া দিল। ভাবের প্রবাহও তেমনি করিয়াই বহিয়া চলিয়াছে; সে ছােটাে বড়ো কত কারণের দ্বারা খণ্ড হইতে এক এবং এক হইতে শতধা হইয়াকত রূপািরপান্তরে ছড়াইয়া পড়িতেছে। সম্মিলিত মানবের বৃহৎ মন, মনের নিগৃঢ় এবং অমােঘ নিয়মেই আপনাকে কেবলই প্রকাশ করিয়া অপরূপ মানসসৃষ্টি সমস্ত পৃথিবীতে বিস্তার করিতেছে। তাহার কত রূপ, কত রস, কতই বিচিত্র গতি। লেখককে যখন আমরা অত্যন্ত নিকটে প্রত্যক্ষ করিয়া দেখি তখন লেখকের সঙ্গে লেখার সম্বন্ধটুকুই আমাদের কাছে প্রবল হইয়া উঠে ; তখন মনে করি গঙ্গোত্রই যেন গঙ্গাকে সৃষ্টি করিতেছে। এইজন্য জগতের যে-সকল কাব্যের লেখক কে তাহার যেন ঠিকানা নাই, যে-সকল কাব্য আপনাকেই যেন আপনি সৃষ্টি করিয়া চলিয়াছে, অথচ যাহার সূত্র ছিন্ন হইয়া যায় নাই, সেই সকল কাব্যের দৃষ্টান্ত দিয়া আমি ভাবসৃষ্টির বিপুল নৈসর্গিকতার প্রতি আপনাদের মন আকর্ষণ করিবার চেষ্টা করিয়াছি। আষাঢ় ১৩১৪ বাংলা জাতীয় সাহিত্য বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎসভার বার্ষিক অধিবেশনে পঠিত সহিত শব্দ হইতে সাহিত্য শব্দের উৎপত্তি। অতএব ধাতুগত অর্থ ধরিলে সাহিত্য শব্দের মধ্যে একটি মিলনের ভাব দেখিতে পাওয়া যায়। সে যে কেবল ভাবে-ভাবে ভাষায়-ভাষায় গ্রন্থে-গ্রন্থে মিলন তাহা নহে; মানুষের সহিত মানুষের, অতীতের সহিত বর্তমানের, দূরের সহিত নিকটের অত্যন্ত অন্তরঙ্গ যোগসাধন সাহিত্য ব্যতীত আর-কিছুর দ্বারাই সম্ভবপর নহে। যে দেশে সাহিত্যের অভাব সে দেশের লোক পরস্পর সজীব বন্ধনে সংযুক্ত নহে; তাহারা বিচ্ছিন্ন। পূর্বপুরুষদের সহিতও তাঁহাদের জীবন্ত যোগ নাই। কেবল পূর্বপরপ্রচলিত জড়প্রথাবন্ধনের দ্বারা যে যোগসাধন হয় তাহা যোগ নহে, তাহা বন্ধন মাত্র। সাহিত্যের ধারাবাহিকতা ব্যতীত পূর্বপুরুষদিগের সহিত সচেতন মানসিক যোগ কখনো রক্ষিত হইতে পারে না । আমাদের দেশের প্রাচীন কালের সহিত আধুনিক কালের যদিও প্রথাগত বন্ধন আছে, কিন্তু এক জায়গায় কোথায় আমাদের মনের মধ্যে এমন একটা নাড়ীর বিচ্ছেদ ঘটিয়াছে যে, সেকাল হইতে মানসিক প্রাণরস অব্যাহতভাবে প্রবাহিত হইয়া একাল পর্যন্ত আসিয়া পীে ছিতেছে না। আমাদের পূৰ্বপুরুষেরা কেমন করিয়া চিন্তা করিতেন, কার্যকরিতেন, নব তত্ত্ব উদভাবন করিতেন- সমস্ত শ্রুতি পুরাণ কাব্যকলা ধর্মতত্ত্ব রাজনীতি সমাজতন্ত্রের মর্মস্থলে তঁহাদের জীবনশক্তি র্তাহাদের চিৎশক্তি জাগ্রত থাকিয়া কী ভাবে সমস্তকে সর্বদা সৃজন এবং সংযমন করিত— কী ভাবে সমাজ প্রতিদিন বৃদ্ধিলাভ করিত, পরিবর্তনপ্রাপ্ত হইত, আপনাকে কেমন করিয়া চতুর্দিকে বিস্তার করিত, নূতন অবস্থাকে কেমন করিয়া আপনার সহিত সম্মিলিত করিত— তাহা আমরা সম্যকরূপে জানি না। মহাভারতের কাল এবং আমাদের বর্তমান কালের মাঝখানকার অপরিসীম বিচ্ছেদকে আমরা পূরণ করিব কী দিয়া ? যখন ভুবনেশ্বর ও কনারক মন্দিরের স্থাপত্য ও ভাস্কর্য দেখিয়া বিস্ময়ে অভিভূত হওয়া যায় তখন মনে হয়, এই আশ্চর্য শিল্পকৌশলগুলি কি বাহিরের কোনো আকস্মিক আন্দোলনে কতকগুলি প্রস্তরময় বুদবুদের মতো হঠাৎ জাগিয়া উঠিয়াছিল ? সেই শিল্পীদের সহিত আমাদের যোগ কোনখানে ? যাহারা এত অনুরাগ এত ধৈৰ্য এত নৈপুণ্যের সহিত এই সকল অভ্ৰভেদী সৌন্দর্য